ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ৩০ চৈত্র ১৪৩১

ইউনূস-মোদি বৈঠক

নতুন পররাষ্ট্রনীতির দিক উন্মোচন

মোহাম্মদ ইমতিয়াজ উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৯:৫৫, ১২ এপ্রিল ২০২৫

নতুন পররাষ্ট্রনীতির দিক উন্মোচন

গত সপ্তাহে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার বৈঠকের অর্জন বা লাভ-লোকসান নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে আলোচনা। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নয়ন কিংবা সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনার বিকল্প নেই। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘আলোচনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন, তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গগুলো উঠে এসেছে। দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ হয়েছে।’
অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। দুই দেশের সরকারপ্রধানের বৈঠক হয়েছে বিশেষ পরিস্থিতিতে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন ও উত্তেজনা চলছিল। বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদল যদিও এই দেশের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল, তবু দিল্লির নীতিনির্ধারকরা তা মানতে পারছিলেন না কিছুতেই। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ ও যাতায়াত জরুরি। দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ভারত পর্যটন ভিসা বন্ধ রেখেছে। মেডিক্যাল ভিসার ওপরও আরোপ করা হয়েছে কড়াকড়ি।
বাংলাদেশ ও ভারত দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার স্থলসীমান্ত ছাড়াও আছে ৫৪টি অভিন্ন নদী। মোদি সরকারের আমলে স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধান হলেও অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ ও ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের এই বৈঠককে আমরা স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে এ কথাও মনে করি যে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, তা নিরসনে একটি বা দুটি বৈঠকই যথেষ্ট নয়। সর্বস্তরে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুই সরকারপ্রধানের বৈঠকের তাগিদ দেওয়া হয়েছিল আগে থেকেই। বিশেষ করে গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ঢাকা এই বৈঠকের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মানুষ তাঁর কথার বাস্তবায়ন দেখতে চাইবে। ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা খোলাখুলি সেখানকার সাংবাদিকদের সরেজমিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। দিল্লির পক্ষ থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য পরিহার করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ ব্যাপারে ভারতেরও যথেষ্ট সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তা ছাড়া ভারতে বসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন, তা যে দুই দেশের মাঝে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে, সেটাও ভারতের নীতিনির্ধারকদের আমলে নিতে হবে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ইউনূস-মোদি বৈঠক পরবর্তী বিশেষ প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, যেকোনো গণতন্ত্রে নিয়মিত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন খুব জরুরি একটি ব্যাপার। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়েও প্রফেসর ইউনূসকে অবগত করেছেন। বিক্রম মিশ্রির এই বক্তব্যের সূত্রে বলা যায়, এর আগে বাংলাদেশে তিনটি নির্বাচনের দুটি পুরোপুরি একতরফাভাবে হলেও ভারতকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি। ভারতের এ ধরনের দ্বিমুখী অবস্থান বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা বাড়াতে সাহায্য করেছে।
দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহল ইউনূস-মোদি বৈঠককে ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের মধ্যে আশার আলো দেখার কথা বলেছেন। ভারতের কূটনৈতিক মহল মনে করে, বাংলাদেশ যাতে চীন ও পাকিস্তানের প্রতি আরও ঝুঁকে না পড়ে, সে জন্য দিল্লির কর্তব্য হবে ঢাকাকে আস্থায় নেওয়া।
বাংলাদেশ-ভারত পাশাপাশি এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকা খুবই জরুরি। কেননা, গত ৫ আগস্টের পর থেকে দুই দেশের মাঝে যে সম্পর্কের টানাপোড়ন চলছে, তাতে লাভের চেয়ের লোকসানের পাল্লাই যেন বেশি। ভারত বাংলাদেশীদের কাছে পর্যটন শিল্প, চিকিৎসা শিল্প ইত্যাদি যে সেবাগুলো দেওয়ার মাধ্যমে বাণিজ্য করতে পারত, তা এই সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে প্রায় বন্ধ। অনুরূপভাবে, অসংখ্য বাংলাদেশী ভারতে গিয়ে যে উন্নত চিকিৎসা লাভ করতো, তা থেকে তারা আজ বঞ্চিত হচ্ছে। একইভাবে সম্পর্ক ভালো থাকলে বাংলাদেশও ভারতে ইলিশ ও পোশাক রপ্তানি করতে পারত। তাছাড়া দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতের সুবিধা বেশি। যাতায়াত সুবিধার কারণে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হলে তাতে খরচ অনেক কম পড়বে। দুই দেশের ব্যবসায়ী মহলের জন্যও তাতে বেশ সুবিধা হয়।
আমরা মনে করি সমতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কোনোভাবেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে টেনে আনা সমীচীন নয়। দেরিতে হলেও দুই দেশের সরকারপ্রধান মুখোমুখি বসে কথা বলেছেন। নিজেদের উদ্বেগ ও প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। আশা করি, এখন বাকি কাজগুলো উচ্চ কূটনৈতিক পর্যায়ে এগিয়ে নেওয়া হবে।

×