
সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় পণ্যের উৎপাদন-সরবরাহ সর্বত্রই নতুন মাত্রিকতা তৈরি করে আসছে। প্রচলিত বিধানে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহে নানামুখী চাহিদা-জোগানের সমস্যা বিদ্যমান। দেশের আপামর জনগণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা পূরণ প্রত্যেক জাতিরাষ্ট্রের সরকারের ওপর বর্তায়। বন্যা-খরা-অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টিসহ বিভিন্ন পরিবেশগত কারণে অধিকাংশ সময় দেশসমূহে কৃষি-শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে সৃষ্টি হয় দ্রব্যের অভাব। ক্ষেত্র বিশেষে অসাধু মুনাফালোভীদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্যে দ্রব্যমূল্য ওঠানামা করে যাতে সময় সময় জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছে। এসব উদ্ভট সংকট নিরসনে আমদানি-রপ্তানির ভূমিকা বিশেষ অবদানে পরিপুষ্ট। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ধরনের রীতিনীতি প্রযোজ্য। একদিকে আয়কৃত শুল্ক যেমন দেশের রাজস্বের অন্যতম উৎস, অন্যদিকে রপ্তানি আয়, প্রবাসীদের রেমিটেন্স ইত্যাদির ভূমিকা অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়মিত যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলো হলো- চাল, গম, ডাল, তৈলবীজ, তুলা, অপরিশোধিত পেট্রোল ও পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য, ভোজ্যতেল, সার, কৃষি ও শিল্প যন্ত্রপাতি, সুতা ইত্যাদি। আর এসব দ্রব্য আমদানি করা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি। বাংলাদেশের পণ্য আমদানির সর্বোচ্চ ৪৩ শতাংশ আসে ভারত ও চীন থেকে।
পক্ষান্তরে দেশের রপ্তানিকৃত পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তৈরি পোশাক, হিমায়িত চিংড়ি, কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য, ওষুধ সামগ্রী, চা, চামড়াজাত দ্রব্য, রাসায়নিক সামগ্রী প্রভৃতি। বাংলাদেশ যেসব দেশে পণ্য রপ্তানি করে সেসব দেশ হলো- যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, জাপান ইত্যাদি। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে তৈরি পোশাক। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে এ পণ্য থেকে। আবার একক রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হলো তৈরি পোশাকের প্রধান রপ্তানি বাজার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ২০-২২ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুসারে ২০২৪ পঞ্জিকা বছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৭২০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা বছরের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ১৯ শতাংশ। সূত্র মতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে মোট রপ্তানি আয় আসে ২৮ দশমকি ৯৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি। তাছাড়া চলতি অর্থবছরের এই সাত মাসে ১০ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধি পেলেও আমদানি বেড়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।
১২ মার্চ ২০২৫ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলমান অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মাসে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৬৩৬ কোটি ডলারের পণ্য ও সেবা। বিপরীতে আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৮১১ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে এই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ১৭৫ কোটি ডলার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই সময়ে দেশের সার্বিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ১১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। বছরের ব্যবধানে ঘাটতি ৯ দশমিক ০১ শতাংশ কমলেও এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। প্রাসঙ্গিকতায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো গণমাধ্যমে বলেন, ‘নতুন সরকার এসে অনেক জায়গায় উন্নতি করেছে। কিন্তু বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে তেমন ইতিবাচক উন্নতি নেই। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হওয়াটা খুবই জরুরি। মূলধনী যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানার আমদানিতে স্থবিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যাংকের উচ্চ সুদহারের কারণে বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করতে না পারায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পরিকল্পনাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তারা কয়েকটি স্পেশাল ইকোনমিক জোন চালু করতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্যাস সংযোগ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া যাচ্ছে না।’
সচেতন মহল অবগত আছেন যে, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও দুদেশের বাণিজ্যের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেশি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইউএসটিআর) তথ্যানুসারে ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ২০২৩ সালের তুলনায় ১ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ২৯১ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল রয়েছে ২৯ কোটি ডলারের এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের পণ্য ২৬২ কোটি ডলারের। এই ২৬২ কোটি ডলারের পণ্যের মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানিতে কোনো শুল্ক-কর দিতে হয়নি। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া পণ্যে গড়ে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ শুল্ক-কর দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে কাস্টমস শুল্ক-কর আদায় করেছে ১ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মার্কিন পণ্যের উচ্চ শুল্কহার আরোপসহ বিশ্বজুড়ে মার্কিন বাণিজ্যের ভারসাম্যের লক্ষ্যে অতিসম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের ১৮৪টি দেশের ওপর নতুন শুল্কনীতি আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা পণ্যের ওপর বর্তমানে প্রচলিত শুল্কের সঙ্গে অতিরিক্ত এ শুল্কারোপ করার নীতি নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতিতে শূন্যশুল্ক সুবিধা ভোগকারী দেশগুলোকেও ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। দেশভেদে এ অতিরিক্ত শুল্কের পরিমাণ ১১-৫০ শতাংশ। যে দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি সে দেশের ওপরই বেশি হারে শুল্কারোপ হয়েছে। বাংলাদেশের পণ্যে শুল্কারোপ করা হয়েছে ৩৭ শতাংশ। তবে দেশটির বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার ওপর আরোপকৃত শুল্কের হার যথাক্রমে ৪৬ ও ৪৯ শতাংশ। তাছাড়া ভারত ২৬, চীন ৩৪, পাকিস্তান ২৯ এবং শ্রীলঙ্কার ওপর ৪৪ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর নিজ নিজ দেশ যত শতাংশ শুল্ক আদায় করে আসছিল মার্কিন সরকার সেসব দেশের শুল্কহারের অর্ধেক অতিরিক্ত শুল্ক হিসেবে তার দেশে রপ্তানি করা পণ্য থেকে আদায়ের নীতি গ্রহণ করেছে।
ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ইতোমধ্যেই বহু দেশের শেয়ারবাজারে উল্লেখযোগ্য দরপতন পরিলক্ষিত হয়েছে। ৪ এপ্রিল খোদ যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি প্রধান শেয়ারের সূচক ৫ শতাংশের বেশি কমেছে। পাঁচ বছরের মধ্যে এটি দেশটির পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় ধসের ঘটনা। একইভাবে সূচক কমেছে জার্মানি ও ফ্রান্সের পুঁজিবাজারেও। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এই পাল্টা শুল্ক বিশ্বকে বাণিজ্যযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি করবে। এরই মধ্যে তার লক্ষণ সুস্পষ্ট। শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশসহ অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই পরিবর্তন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এমন অনিশ্চিত ব্যবস্থায় তীব্র অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম বৃহৎ বাজার হওয়ার কারণে এই নতুন শুল্ক পোশাক খাতে আঘাত হানার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের কাছে দাম বেশি হলে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকট। অর্থনীতিবিদদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপেও বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা কমবে বলে মন্তব্য করেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে এনে সংকট মোকাবিলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ অতিশয় দৃশ্যমান। তিনি বাংলাদেশী পণ্যের ওপর পাল্টা শুল্কারোপ তিন মাসের জন্য স্থগিতের অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে ভালো অবস্থানে বাংলাদেশকে কিভাবে নেওয়া যায় সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বৃদ্ধি ও মার্কিন পণ্যের শুল্কহার কমানোর পরিকল্পনা সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচ্য। এরই মধ্যে আরোপিত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে এলএনজি আমদানির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় একশ’টি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আশা জাগানিয়া বিষয় হচ্ছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক নিয়ে অনুরোধ জানানো দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার এবং তিন মাস পাল্টা শুল্ক স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন। সামগ্রিক বিবেচনায় এটি স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের এহেন উদ্যোগ বিশ্ববাজার ব্যবস্থাকে অস্থির করে তুলেছে। এতে শুধু বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও এর নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা প্রবল। ইতোমধ্যেই এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রত্যেক রাজ্য-নগর-শহরে জনগণের প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা মার্কিন সরকার অচিরেই একটি যৌক্তিক শুল্ক কাঠামো ঘোষণা করবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ
সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী