ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

ঐ নতুনের কেতন ওড়ে

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৯:১৫, ১২ এপ্রিল ২০২৫

ঐ নতুনের কেতন ওড়ে

১৪৩১ বঙ্গাব্দ তার বিদায় ঘণ্টায় জনগণের জীবন প্রবাহে সাড়া জাগিয়ে দিচ্ছে। চৈত্রের অন্তিম সময় জানান দিচ্ছে খরতাপ আর বৈশাখ তার আগমনী বার্তায় নৈসর্গকে ব্যাকুল করছে। ঋতুবৈচিত্র্যের মন মাতানো আবহে বাংলার যে রূপ-শৌর্য তাই এই বরেন্দ্র অঞ্চলের নাতিশীতোষ্ণ প্রতিবেশের পরম বরমাল্য। ছোটবেলায় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কিভাবে মৃদুমন্দ শীত বসন্তের আবহে খরতাপ চৈত্রের মধ্যাহ্ন প্রখরভাবে বৈশাখকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তবে শস্য শ্যামল সবুজ বাংলা ষড়ঋতুর রূপময় শৌর্যে কোলের সন্তানদের এখনো মাতিয়েও দেয়। আর বাংলার নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তৈরি বৈশাখের চরম উষ্ণতার প্রতিবেশ। শ্যামল বাংলা তখন তাপপ্রবাহে এক জীর্ণ অসহনীয় প্রচণ্ড রৌদ্রস্নানে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর অতি সাধারণ মানুষের নিত্যজীবন যেভাবে তাপের কিরণে দগ্ধ হয় সেটা এই উর্বর পলিমাটির বাংলার চিরায়ত আবহের অনন্যচিত্র। বরাবরই নান্দনিক বাংলার সৃজন বোদ্ধারা নানাভাবে বৈশাখকে চিত্রায়িত করেছেন তাদের সৃষ্টি ভাণ্ডারের নৈমিত্তিক ভাব কল্পনায়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলও তাপদগ্ধ বৈশাখকে আমন্ত্রণ জানান ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখির ঝড়।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তো পরম আবেগে সারা বাংলাকে মাতিয়ে দিলেন তার সৃজনক্ষমতার অনন্য রূপের মাধ্যমে। বর্ষবরণ করলেন যেন যথার্থভাবেই খরতাপকে আবাহনে অভিনন্দিত করে।
 এসো হে বৈশাখ এসো এসো
তাপস নিঃশ^াস বায়ে,
মুমূর্ষুরে দাও উড়াইয়ে।
বাংলা আর বাঙালিয়ানার পরম বন্দনায় রৌদ্রদগ্ধ প্রতিবেশে যে আবাহন বৈশাখের সূচনালগ্ন সেটা চিরায়ত বঙ্গভূমির রূপশৌর্য। ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা শ্যামল বাংলার শুধু উর্বর নরম পলিমাটিই নয়। বরং ক্ষেতের ফসল পাকাপোক্ত হওয়ার জন্য রৌদ্রস্নাত পরিবেশও যে খুব জরুরি সেটা শৈল্পিক স্রষ্টাদেরও নানামাত্রিকে উদ্বেলিত করে। বৈশাখের নতুন তাপপ্রবাহ জীবনকে শুধু কাহিলই করে না বরং সৃজন কল্পনায় তাপদগ্ধ বাতাসকে নববর্ষের নতুন সৃষ্টির আনন্দে ব্যাকুলও করে দেয়। সেটা প্রকৃতিই নানামাত্রিকে অনুভব করিয়ে দিতে সচেষ্ট থাকে। এখন আমরা চৈত্র সংক্রান্তির পর্বে দাঁড়িয়ে বৈশাখকে বরণের যে ডালা সাজিয়েছি সেখানে ঋতুরাজ বসন্তের অন্তিম সময়। আর নববর্ষ বরণে আনন্দ মিশ্রণে যে পরিমিত আবহে প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তানদের উন্মুখ করে তোলে তাও এই অঞ্চলের অনন্য শোভিত এক চৈত্র আর বৈশাখের সম্মিলন বলাই যায়। ঝরাপাতার মর্মর ধ্বনি ইতোমধ্যে নৈসর্গকে ব্যাকুল করে দিচ্ছে। তেমন সাঙ্গিতিক মূর্ছনায় প্রকৃতিও নব আভরণে নিজেকে অভিষিক্ত করছে। আর ১৪৩২ সাল তার শুভ পদার্পণে অনন্য ইঙ্গিতে নৈসর্গ আর সংশ্লিষ্ট কোলের সন্তানদের নব সৃষ্টির উন্মাদনায় ব্যাকুল করে তুলছে। কবিগুরু উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানানÑ এই অগ্নিস্নানেই বাংলার মাটি শুচিতায় মোড় নেবে। উতপ্ত তাপপ্রবাহে অন্যায়, অবিচার, পাপস্খলনÑ সবই যেন প্রকৃতির অবিস্মরণীয় অবদান। এমন পরম সন্ধিক্ষণে প্রকৃতিও কিছু মাত্র দিশাহারা হয়ে যায়। কখনো ঝরাপাতার বেদনায় সময় অসময়ে কাল বৈশাখীর ঝাপটায় নৈসর্গের যে রুদ্র, রুক্ষ্ম মূর্তি তা যে অগ্নিস্নানের খরতাপকেও অতিক্রম করে যায়। তাই বিপ্লবী কবি নজরুলও ঝড় আর নবযাত্রাকে মিলে মিশে যেন একাকার করেন তাঁর স্বভাবসুলব বৈপ্লবিক মনস্তত্ত্বে। আমাদের ক্ষুদ্র বাংলাদেশ নৈসর্গের সৌরভেই শুধু আকুলিত হয় না বরং অসহনীয় ঝড়ঝাপটাকেও মোকাবিলা করে উপকূলীয় এই অঞ্চলবাসী লড়াই-সংগ্রামে নিজেদের টিকিয়ে রাখে।
খরতাপের নিদারুণ দগ্ধতায় কোলের সন্তানরা ঝড়ঝাপটাকেও মোকাবিলা করে চলার গতিপথকে অবারিত করে। তার পরও বৈশাখে নব আনন্দে সূর্যোদয়ের প্রতি গভীর মর্যাদা আর পরম নিবেদনে যে মাত্রায় শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় সেটাও দৃষ্টিনন্দনভাবে এই অঞ্চলের পরম বরমাল্য বৈকি। নবপ্রভাতের নতুন সূর্যোদয়ে দেশের যে আনন্দঘন যাত্রার শুভ সূচনা তাও অঞ্চলভিত্তিক এক অভাবনীয় দ্যোতনা। প্রতিবারের মতো এবারও বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশ আর এক শুভক্ষণের দ্বারপ্রান্তে। আনন্দ শোভাযাত্রার বর্ণাঢ্য আয়োজনের প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হচ্ছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে শুরু হওয়া এই বর্ণাঢ্য মঙ্গলযাত্রা আবহমান বাংলার কৃষি সম্পদ থেকে শুরু করে হরেক দর্শনীয়, শোভনীয় কলা কৌশলে সে যাত্রার শুভারম্ভ। তা প্রখর খরতাপেও বিচলিত না হওয়া উৎসবমুখর বাঙালি জাতির পরম আরাধ্য সাধনযজ্ঞ। আমাদের চিরায়ত সাংস্কৃতিক চেতনার বাতাবরণে নববর্ষকে প্রতিবারই নতুনভাবে আবাহন করা জাতিগত ও প্রথাসিদ্ধ বৈভবের সার্বজনীন কর্মযোগ বললে অতিকথন নয়। কোমলমতি শিশুরাও হাতে-পায়ে আলপনা একে মঙ্গল শোভাযাত্রার বর্ণাঢ্য আয়োজনে শরিক হয়। আবার শুধু এক দিনের বর্ণাঢ্য আয়োজন নয় সনাতন ধর্মাবলম্বীর নারীরা বৈশাখ মাসে সূর্যকিরণ থাকা পর্যন্ত রাতের আহার সমাপ্ত করেন স্বামী-সন্তানের মঙ্গলের জন্য। যাকে বেলভাতা বলা হয়। মানে বেলা সম্পন্ন থাকতেই রাতের আহার সম্পাদন করা। পরবর্তীতে নির্জলা উপবাস। যাকে এক প্রকার পার্বণ বলা যায়। বৈশাখের প্রথম প্রহরে যে হরেক ভর্তার পরিবেশন গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক আহার। সেটাও এই অঞ্চলের খাদ্য সংস্কৃতির অপার মহিমাও বটে। আবার পান্তা ইলিশের যে ভোজন আপ্যায়ন সেটা সমুদ্র পরিবেষ্টিত, নদীমাতৃক উর্বর পলিমাটির আবহমান বঙ্গভূমির আজন্মের আহার সংস্কৃতির উপাদেয় সম্ভার। যা মাছে ভাতে বাঙালির প্রবাদতুল্য বৈভবের নৈমিত্তিক সম্পদ। তবে জাতীয় মাছ ইলিশ এখন সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সেটা নতুন ও আধুনিক বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তির উদ্ভাবনই শুধু নয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। নদি ভরাট, ফসলি জমির আয়তন কমে যাওয়া সবই পরিস্থিতিকে বেসামাল করে দেয়। যার প্রমাদ গুণতে হচ্ছে মাছে ভাতে বাঙালির সর্ববিধ জীবনাচরণের প্রতিটিক্ষণে। ১৪৩২ সালকে স্বাগত জানিয়ে বাংলার নববর্ষকে আমন্ত্রণ আর আয়োজনেও হোক শাশ^ত বঙ্গভূমির চিরস্থায়ী শৌর্য।

×