ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

আওয়ামী লীগ, ভোটাধিকার ও ভারত: একটি যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম

প্রকাশিত: ০০:৪২, ১২ এপ্রিল ২০২৫

আওয়ামী লীগ, ভোটাধিকার ও ভারত: একটি যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে পরপর তিনবার সরকার গঠন করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—এই সরকারগুলো কি জনগণের ভোটে নির্বাচিত? ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪—এই তিনটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যেভাবে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ বিঘ্নিত হয়েছে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে, তা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এমনকি ভারতের কৌশলগত নীরবতাও এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক প্রশ্ন তোলে।

২০১৪: একতরফা নির্বাচন, ভোটহীন জনগণ
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ অংশ না নেয়ার ফলে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়। দেশের ৫ কোটি ভোটার ভোট দেয়ার সুযোগই পাননি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই নির্বাচনকে "নন-ইনক্লুসিভ" এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বলেও চিহ্নিত করে। অথচ এই সময়েও ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল।

২০১৮: রাতের ভোট, ভোটারবিহীন কেন্দ্র
২০১৮ সালের নির্বাচনে আগেই ফল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল—এমন অভিযোগ বহু পর্যবেক্ষক সংস্থার। নির্বাচনের আগের রাতেই ভোট বাক্স পূর্ণ করার অভিযোগ ছিল। বিশিষ্টজনদের বক্তব্যে উঠে আসে, নির্বাচন ছিল "গণতন্ত্রের প্রহসন।" ভারতের অবস্থান? আবারও দৃঢ় সমর্থন।

২০২৪: ছদ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভোটের নামে আনুষ্ঠানিকতা
২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বর্জন করে। অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দল কার্যত আওয়ামী লীগের সহযোগী বা সরকারঘনিষ্ঠ ছিল। ভোটার উপস্থিতি ছিল অস্বাভাবিক কম। নির্বাচন কমিশন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদেরও আমন্ত্রণ জানায়নি। অথচ ভারত এই নির্বাচনকেও "অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ" বলে অভিনন্দন জানায়।

ভারতের ভূরাজনৈতিক কৌশল ও বাংলাদেশের বাস্তবতা
ভারত একটি স্পষ্ট আধিপত্যবাদী (hegemony-driven) কৌশল অনুসরণ করে। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের "বড় ভাই" হিসেবে প্রতিষ্ঠা রাখতে চায়। বাংলাদেশ তাদের জন্য একটি কৌশলগত গেইটওয়ে:

  • পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্ন রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা
  • চীনকে প্রতিহত করার জন্য বাংলাদেশকে পাশে রাখা
  • বাণিজ্য ও কাঁচামাল প্রবাহ নিশ্চিত করা
  • আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও ইসলামি চরমপন্থা প্রতিরোধে বাংলাদেশকে সহায়ক রাষ্ট্র হিসেবে ব্যবহার

এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত চায় একটি স্থিতিশীল, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত ও সুবিধাবান্ধব সরকার বাংলাদেশে থাকুক। তাই তারা গণতন্ত্রের চেয়ে নীতিগত সুবিধা ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়।

দ্বিচারিতা: ভারতের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের দাবি, বাইরে সহ্যশীলতা?
ভারতের নিজস্ব রাজনীতিতে গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা, এবং অবাধ নির্বাচনের প্রশ্নে তারা অত্যন্ত সংবেদনশীল। অথচ প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে তাদের মানদণ্ড ভিন্ন। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ—এমনকি পাকিস্তান সম্পর্কেও তারা নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে একচেটিয়া রাজনৈতিক সমর্থন দেখিয়ে থাকে।

ভবিষ্যতের প্রশ্ন: ভারতের এই কৌশল কি টিকবে?
ভারত বুঝতে পারছে যে দীর্ঘমেয়াদে একটি অজনপ্রিয়, দমনমূলক সরকারের ওপর নির্ভর করা কৌশলগত ভুল হতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট যেভাবে বাড়ছে, তা আঞ্চলিক অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে। এজন্য ভারত ধীরে ধীরে একটি অন্তর্বর্তীকালীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া সমর্থন করার পথে এগুচ্ছে—যেখানে বিএনপিসহ সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

তাদের এই অবস্থান পরিবর্তন এই সত্যেরও স্বীকৃতি যে—যদি বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হয়, তাহলে ভারতও নিরাপদ নয়।

উপসংহার: গণতন্ত্রের বিকল্প নেই
বাংলাদেশের জনগণ গণতন্ত্র চায়, ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে চায়। যে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উচিত সেই আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করা। ভারতের উচিত বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পক্ষে দাঁড়ানো, সুবিধাবাদী কৌশলের বদলে।

লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র

এম.কে.

×