ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

ভারতের সাম্প্রতিক অবস্থান এবং কিছু প্রশ্ন

জুবায়ের হাসান

প্রকাশিত: ২০:২১, ১১ এপ্রিল ২০২৫

ভারতের সাম্প্রতিক অবস্থান এবং কিছু প্রশ্ন

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তার জন্ম লাভের পর কয়েকবার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গোলযোগের সম্মুখীন হয়েছে। এদেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তখনই এদেশের বিরুদ্ধে ভারতের অপতৎপরতা প্রকাশ্যে লক্ষ্য করা গেছে। ভারত চায়নি বাংলাদেশ কোনো রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠে স্থিতিশীল হোক। বরং সে বাংলাদেশকে গভীর গোলযোগের মধ্যে ঠেলে দিতে আরও বেশি তৎপর থেকেছে। ৫৪ বছর আগে স্বাধীনতা লাভের পর ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও বিপ্লব এদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঘটনা। মানুষ এ ঘটনাকে বলছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। ২০২৪-এর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। এর আগে হাসিনা ১৫ বছর ধরে জোরপূর্বক যেভাবে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছিল তার পেছনেও ভারতের অবারিত সমর্থন ছিল। এ কারণে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান ও বিপ্লব শুধু শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়নি, বরং একই সঙ্গে তা ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিতাড়িত করার সংগ্রাম। এ কারণেই শেখ হাসিনার পতন ভারত মেনে নিতে পারেনি। হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাবার পর থেকেই ভারতীয় প্ররোচনায় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য চলতে থাকে নানা অপতৎপরতা। কিন্তু এ দেশের সংগ্রামী জনতা ও নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিটি অপতৎপরতা ব্যর্থ হয়। তবে নানা অপতৎরতা এখনো চলমান রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ভারতীয় মিডিয়ার আগ্রাসনের শিকার হয়ে চলেছে প্রতিনিয়তই। বাংলাদেশ যখন পরিবর্তনের ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে রয়েছে তখনই ভারতের তরফ থেকে এদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে হাইব্রিড যুদ্ধ। যেখানে ভুল ও বিকৃত তথ্য, ভুয়া খবর ও অপতথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকার, সেনাবাহিনী, অপরাপর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থের হানি ঘটলেই ভারত এদেশে রাজনৈতিক গোলযোগ ও অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করতে থাকে এবং এদেশের ওপর চাপ প্রয়োগের নীতি অবলম্বন করে চলে। এক্ষেত্রে ভারত বরাবরই আদি তিন কৌশল অবলম্বন করে। যথা : কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ উত্থানের অজুহাত পেশ এবং বাংলাদেশকে ভেঙে ফেলার হুমকি প্রদান। হাসিনা পতনের পর ভারত ক্রমাগতভাবে এই তিন কৌশল অবলম্বন করে চলেছে।  
সংখ্যালঘু কার্ড খেলার ভারতীয় লক্ষ্য হলো এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে বেকায়দায় ফেলা এবং সারা বিশ্বে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপারে যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। কোনো প্রকারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা সংখ্যালঘু নির্যাতনের আবহ তৈরি করা গেলে তখন তাদের রক্ষার জন্য বিদেশী সৈন্য মোতায়েনের দাবি তোলা। এসব বাসনা থেকেই খেলা হয় সংখ্যালঘু কার্ড। ভারতীয় দ্বিতীয় কৌশল হলো এদেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ উত্থানের বিষয়ে প্রচারণা চালানো। হাসিনার শাসনামলে ১৫ বছর ধরে ভারত আড়াল থেকে এই মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ উত্থানের কার্ডটি সফলভাবে খেলতে সক্ষম হয়। হাসিনার পতন পরবর্তী যুগে এ বিষয়ে ভারতীয় মিডিয়া আবার তৎপর হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়ায় অনবরত প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বলা হতে থাকে ইসলামী মৌলবাদীদের নেতা। সাম্প্রতিককালে ভারতীয় মিডিয়া সিন্ডিকেট তাদের তৎপরতা অন্য দেশেও বিস্তৃত করেছে। ভারতীয় মিডিয়ার ইন্ধনে মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপানো হয় বাংলাদেশে মৌলবাদ উত্থানের মনগড়া প্রতিবেদন। একইভাবে জাপানি পত্রিকা নিক্কি এশিয়াতেও ছাপানো হয়েছে বাংলাদেশে মৌলবাদের কথিত উত্থান কাহিনী। এসব গণমাধ্যমে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে গত ৭ মার্চ নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীরের এক-দেড়শ কর্মীর মিছিলের ছবি। হিযবুত তাহরীরের মিছিলে ব্যবহৃত প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারের রং দেওয়া হয়েছিল ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপির ব্যবহৃত গেরুয়া রঙের সাথে সাদৃশ্য বজায় রেখে। এ থেকেই বোঝা যায় হিযবুত তাহরীরের ওই মিছিল আয়োজনের পেছনে কারা ইন্ধন দিয়েছিল। বাংলাদেশে কথিত জঙ্গিবাদের উত্থান প্রদর্শন এবং পরে তা দমন, এই কৌশলটা মূলত সর্প হয়ে দংশন এবং ওঝা হয়ে বিষ ঝারার কৌশল। এমন কৌশলই প্রয়োগ করা হতো হাসিনার শাসনামলে।
ভারতের তৃতীয় কৌশল হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করা। এটিও এক পুরানো কৌশল। ইতোপূর্বে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পর বাংলাদেশের কয়েকটি জেলাকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলকেও বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হয়েছিল। বাংলাদেশবিরোধী এসব তৎপরতা সীমান্তের ওপার থেকেই পরিচালিত হয়েছিল। হাসিনার পতনের পর গত ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির একটি ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিও ছাড়া হয়। তাতে দেখা যায়, একদল প্রশিক্ষণরত যুবক স্লোগান দিচ্ছেন বঙ্গ সেনা দিচ্ছে ডাক, বাংলাদেশ করো ভাগ। গত ১ এপ্রিল ভারতের ‘স্বরাজ্য’ (Swarajya) নামের একটি অনলাইন ম্যাগাজিনে জয়দীপ মজুমদারের লিখিত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল Carving A Homeland for Hindus of Bangladesh And Unlocking The Landlocked Northeast. ওই নিবন্ধটিতে ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্য তথা সেভেন সিস্টার্সের ভৌগোলিক অসুবিধাসমূহ তুলে ধরা হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর অমানবিক নিপীড়ন ও বৈষম্যে হচ্ছে মর্মে কল্পিত বানোয়াট কাহিনী বর্ণনা করা হয়। এই দুই  কারণ দেখিয়ে পত্রিকাটি বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্রের দাবি তোলে। এভাবে প্রতিবেশী দেশের পত্রিকায় বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনার কথা ছাপানো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর চরম আঘাত।
ভারতের অনেক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ প্রায়ই বাংলাদেশকে দখল করার হুমকি দিয়ে থাকেন। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড ও আসামের লাখ লাখ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঠেলে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। হাসিনার পতনের এক মাসের মাথায় গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং উত্তর প্রদেশের লক্ষ্মৌয়ে তিন বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডারদের যৌথ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি দেশটির শীর্ষস্থানীয় সামরিক কমান্ডারদের বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার নির্দেশ দেন। ঐ বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেন। গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় ঝাড়খন্ড বিধানসভার নির্বাচন। ওই নির্বাচনের প্রচারাভিযানকালে বিজেপির শীর্ষ নেতারা হাজির করেন অনুপ্রবেশ তত্ত্ব। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এক নির্বাচনী জনসভায় (২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪) ঝাড়খন্ড রাজ্যে কথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করে উল্টো ঝুলিয়ে রাখার হুমকি দেন। এর আগেও (২০১৮ সালে) তিনি কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের উইপোকা বলে বিদ্রুপ করেছিলেন। তাদের তিনি বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপেরও হুমকি দিয়েছিলেন। ঝাড়খন্ড রাজ্যের ওই নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে কথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ তত্ত্বে ভারতীয়  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও শামিল হয়েছিলেন। তিনি (২ অক্টোবর, ২০২৪) ঝাড়খন্ডে নির্বাচনী ভাষণদানকালে কথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পর আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মা ঝাড়খন্ডে নির্বাচনী সফরে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন (২৯ অক্টোবর, ২০২৪)। তিনি গণমাধ্যম ‘এএনআই’-কে বলেন, ‘ঝাড়খন্ড শীঘ্রই মিনি বাংলাদেশ হয়ে উঠবে। কেননা সেখানে কথিত বাংলাদেশী মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটায় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাতে আদিবাসী সাঁওতাল উপজাতিদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে হ্রাস পাচ্ছে।’ এর আগে ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হিমান্ত বিশ্ব শর্মা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে অখণ্ড ভারত গঠনের জন্য বিরোধী দল কংগ্রেসকে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের এসব বক্তব্যকে আমরা হাল্কাভাবে দেখতে পারি না। কেননা অতীতে তাদের বক্তব্য বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। যেমন ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আর কখনোই দিল্লির রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না।’ এরপর ১৫ বছর ব্যাপী (২০০৯-২০২৪) শেখ হাসিনাকে ভারতের অনুগত করে রাখার মাধ্যমে তাঁর ওই বক্তব্য বাস্তব রূপ লাভ করেছিল।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরকালে গত ২৮ মার্চ এক সংলাপে বলেছিলেন, নেপাল ও ভুটান স্থলবেষ্টিত দেশ, যাদের কোনো সমুদ্র নেই। ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যও স্থলবেষ্টিত। আমরাই এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক। বাণিজ্যের জন্য এটি একটি বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। সুতরাং এটি চীনা অর্থনীতির একটি সম্প্রসারণও হতে পারে। পণ্য তৈরি করা, উৎপাদন করা, বিপণন করা এবং তা আবার চীনে নিয়ে যাওয়া এবং বাকি বিশ্বে তা ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ হতে পারে এখানে।  ড. ইউনূসের এই বক্তব্যে সামরিক হুমকি কিংবা অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব হানির কোনো কথা ছিল না। বক্তব্যটি ছিল এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তুলে ধরা। যা তিনি কয়েক বছর আগেও একাধিকবার বলেছেন। কিন্তু ড. ইউনূসের এই বক্তব্য ঘিরে ভারতে শুরু হয় তোলপাড়। দেশটির রাজনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক কূটনীতিবিদরা এবং মূলধারার গণমাধ্যমগুলো ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা ড. ইউনূসের বক্তব্যকে বিপজ্জনক ও আক্রমণাত্মক আখ্যা দেন।
ত্রিপুরার টিপরা মোথা পার্টির প্রধান প্রাদ্যত মানিক্য বাংলাদেশ ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেন। তিনি বলেন, ‘১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম ভারতের হাতে থাকলে আজ এ সমস্যা হতো না। আমাদের উদ্ভাবনী ও চ্যালেঞ্জিং প্রকৌশল ধারণার পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ না করে বাংলাদেশ ভেঙে সাগরে প্রবেশের সুযোগ করা উচিত।’ ভারতের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রফুল্ল বকশি সেদেশের সংবাদ মাধ্যম এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বাংলাদেশ তৈরি করেছে ভারত এবং এটি করার সময় কোনো মানচিত্রগত সুবিধা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান আমাদের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রুট শিলিগুড়ি করিডরকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে গলা টিপে মারার উপায় নিয়ে আলোচনা করছে। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ‘তারা (বাংলাদেশ) বুঝতে পারছে না যে, আমরা বাংলাদেশের বিপরীত দিকে একই কাজ করতে পারি। আমরা সমুদ্রের ওপার থেকে তাদের টুঁটি চেপে ধরতে পারি। বাংলাদেশের সমুদ্র সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারি।’ ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও ড. ইউনূসের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানায়। গ্রেসের পক্ষ থেকে এক্সে শেয়ার করা পোস্টে দলটির গণমাধ্যম ও প্রচার বিভাগের প্রধান পবন খেরা লেখেন, ভারতকে ঘিরে ধরতে চীনকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকারের এ মনোভাব আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খুবই বিপজ্জনক।’ আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমান্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, ‘ড. ইউনূসের বক্তব্য ভারতের ‘চিকেনস নেক’ করিডরের দুর্বলতা নিয়ে পাকিস্তান ও চীনের দীর্ঘদিনের প্রচারণাকে মদদ দেবে। এ জন্য তিনি মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে যাওয়ার জন্য বিকল্প সড়কপথ তৈরির আহ্বান জানান। নরেন্দ্র মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সঞ্জীব সান্যাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) ড. ইউনূসের বক্তব্য শেয়ার দিয়ে লিখেন, ‘বাংলাদেশের তথাকথিত গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান সর্বদাই ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ ছিল।’ বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বলেন, ড. ইউনূসের এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার কোনো অধিকার নেই। হাসিনা আমলে সম্পাদিত বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার নিয়ে বাংলাদেশ সরকার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়ে আছে।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘বাংলাদেশ যদি উত্তর-পূর্ব ভারতকে সংযোগের অধিকার দিতে আগ্রহী না হয় তাহলে বিনিময়ে সে নদী তীরবর্তী অধিকার আশা করতে পারে না।’ ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয় শংকরও প্রফেসর ইউনূসের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। গত ৩ এপ্রিল ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিতে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ভারতেরই বঙ্গোপসাগরে দীর্ঘতম উপকূলরেখা রয়েছে যা প্রায় ৬৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ।’ তিনি বঙ্গোপসাগরে দীর্ঘতম উপকূলরেখা ভারতের বলে দাবি করেন।
বর্তমানে বাংলাদেশ তার রাজনৈতিক মোড় পরিবর্তনের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে গত ৯ মার্চ ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী মন্তব্য করেন, ‘বাংলাদেশে সরকার বদলালে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তন হতে পারে।’ জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদীর এমন মন্তব্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ। বস্তুত ভারতীয় গণমাধ্যম, সাবেক কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, সেনাপ্রধান এদের সবারই আকাক্সক্ষা বাংলাদেশে হাসিনা আমলের মতো পুনরায় প্রভাব-প্রতিপত্তি কায়েম করা। এই ভারতীয় আকাক্সক্ষাকে প্রতিহত করতে হলে সচেতন হতে হবে এদেশের জনগণকে। ঐক্যবদ্ধ জনগণই পারে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে টিকিয়ে রাখতে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

×