
উৎসব আমাদের অর্থনীতির বড় একটা চালিকা শক্তি। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান অনুসারে, উৎসব হচ্ছে আনন্দ অনুষ্ঠান, যা অনেকটা ধূমধাম বা জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপন করা হয়। এসব আনন্দ-আয়োজনে জনগোষ্ঠীর বড় অংশ সম্পৃক্ত থাকে। উৎসবকে আড়ম্বরের সঙ্গে উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে তাঁরা নানা পণ্য ও সেবা কিনে থাকেন। নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করেন। উৎসব সামনে রেখে উপহার বিতরণ করাও আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতির অংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ এ ধরনের উৎসবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। যা সাধারণভাবে উৎসবের অর্থনীতি নামে পরিচিত। সব মিলিয়ে উৎসব কেন্দ্র করে শিল্পপণ্য, কৃষিপণ্য, আমদানি করা পণ্য ও সেবা খাতে তৈরি হয় বাড়তি চাহিদা। বাড়তি চাহিদার কারণে পণ্যের জোগানও বাড়ে, যা স্থানীয় উৎপাদন ও আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। পণ্য আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রি থেকে সরকার বাড়তি রাজস্ব পেয়ে থাকে। উৎসবের মহাকর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত অর্থনীতির অংশকে উৎসবের অর্থনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ঈদ উৎসবকে ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ, সেবা খাতের চাহিদা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয় নানা উৎসবের সঙ্গে যখন যুক্ত হয়। তাই ঈদ উৎসব এবং এর পরিধি, এর আমেজ, উৎসব ঘিরে আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস যত বেশি থাকে, অর্থনীতিতে তত বেশি গতির সঞ্চার হয়। বাংলাদেশে প্রধানত দুটি ঈদ উৎসব পালিত হয় যথাÑ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।
ঈদকে কেন্দ্র করে কী পরিমাণ বাড়তি পণ্য ও সেবা বিক্রি হয়, এর নির্ভরযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে আকারে এটি যে অনেক বড়, তা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। ব্যবসায়ীদের ধারণা, পোশাকশিল্পের বার্ষিক বিক্রির প্রায় ৬০ শতাংশ হয় দুই ঈদকে কেন্দ্র করে। ঈদের মতো উৎসবেও মিষ্টিজাতীয় পণ্যের বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। গত এক দশকে করপোরেট, তথা বড় ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য ঈদকেন্দ্রিক উপহার বিতরণের প্রচলন অনেক বেড়েছে। কৃষি, শিল্প, আমদানি, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, সেবা খাত, কর্মসংস্থান, সরকারের রাজস্ব আহরণÑ সবকিছুতেই ঈদ ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। উৎসবে পোশাক, জুতা, গয়না, প্রসাধনী, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এসব চাহিদা পূরণে উদ্যোক্তা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক ব্যস্ততায় দিন কাটায়। পোশাকের কথাই ধরা যাক। দেশে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পোশাকের একটি বড় অংশের জোগান দিয়ে থাকে রাজধানীর পুরান ঢাকা, কেরানীগঞ্জ, কালীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত কারখানাগুলো। ঈদুল ফিতরের তিন-চার মাস আগে থেকে এসব কারখানায় প্রায় ২৪ ঘণ্টা উৎপাদন চলে। পুরান ঢাকার বংশাল, সিদ্দিকবাজারসহ সংলগ্ন এলাকায় চলে ছোট ছোট কারখানায় জুতা ও ব্যাগ তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ। কারখানার মালিক ও শ্রমিকেরা যেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে যান। একই অবস্থা বিরাজ করে দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানায়; সেটি হতে পারে কুটিরশিল্প বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। এ সময় তেল, চিনি, আটা, ময়দা, সেমাই, নুডলসসহ নানা ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যস্ততাও বেড়ে যায়। উৎসবের সময়ে পোশাক, জুতা, গয়না, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। শহরের বড় শপিং মল থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদের ছোট্ট দোকান পর্যন্ত ক্রেতার ভিড়ে হয়ে ওঠে জমজমাট। এমনকি মুদিদোকানের বিক্রিও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। দিন দিন দেশে ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের বিস্তার ঘটছে। সময়ের অভাব, যানজটের ধকল এড়ানো, যাতায়াত ব্যয় সাশ্রয়সহ নানা কারণে ক্রেতা-ভোক্তাদের মধ্যে ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। উৎসবের সময়ে এসব প্ল্যাটফর্মে পণ্য ও সেবা বিক্রি অনেক বাড়ে, যা এই খাতের বিকাশ ও বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ঈদকে কেন্দ্র করে মানুষের চলাচল বেড়ে যায়। তাদের একটি বড় অংশ পরিবার ও স্বজনের সঙ্গে মিলিত হতে শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহরে যায়। একটি অংশ আবার উৎসবকালীন ছুটিকে আরও আনন্দময় করে তুলতে বেরিয়ে পড়ে ভ্রমণে। এতে পরিবহন ও ভ্রমণ খাতে সেবার চাহিদা বাড়ে। ঈদ কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ছোট-বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচল রাখায় এসব খাত বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থানের প্রায় ৬০ শতাংশই এসএমই, তথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ওপর নির্ভরশীল। এসব শিল্প আবার অনেকাংশে উৎসবের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকে।
বিপুল বেকারের দেশে অসংখ্য তরুণ-তরুণী ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। পাশাপাশি সেখানে কিছু কর্মসংস্থানও তৈরি হচ্ছে।ঈদুল ফিতরে এসব প্ল্যাটফর্মে বিক্রি বাড়ে। উৎসবে কৃষক, অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক, যেমনÑ রিক্সাচালক, ভ্যানচালক, নৌকার মাঝি, মুটে, ডেলিভারিম্যান প্রমুখেরও কাজ এবং আয়রোজগার বাড়ে। ঈদের সময় নানাভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে রক্তসঞ্চালন করে থাকে। ঈদ, পূজা, বিভিন্ন ধরনের মেলা ও পার্বণকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ উৎপাদকদের পণ্য বিক্রি বেড়ে যায়। অন্যদিকে ঈদ সামনে রেখে শহরে ও প্রবাসে থাকা ব্যক্তিরা স্বজনদের কাছে রেমিটেন্স হিসেবে বাড়তি টাকা পাঠান, যাতে তাঁরা উৎসবের ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন। তাতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ বাড়ে, বাড়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এ ছাড়া ঈদ ছুটিতে লাখ লাখ মানুষ নাড়ির টানে গ্রামে ছুটে যান। তাঁরা গ্রামের বাজার থেকে পরিবারের জন্য নানা ধরনের পণ্য কেনেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যান। বিভিন্ন বিনোদনশিল্পসহ আরও অসংখ্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মতো শিল্প খাতেও অবদান রাখে। এ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে, যা গণমাধ্যমের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
এবার ঈদে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে এবং দেশীয় পণ্যের প্রতি ছিল ক্রেতা-ভোক্তার বিশেষ ঝোঁক। বিদেশী পণ্য খুব একটা সহজলভ্যও ছিল না। বিশেষ করে ভারতীয় পণ্যের দাপট এবার দেখা যায়নি। গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর ভারত যেতে ভিসা জটিলতার প্রভাবও ছিল বাজারে। সব মিলিয়ে দেশীয় পণ্যের একচেটিয়া দাপট ছিল এবারের ঈদবাজারে। আবার তুলনামূলক রাজধানীর চেয়ে মফস্বল শহরে এবার বিকিকিনি ভালো হয়েছে। এর একটা বড় অংশই ছিল বাচ্চাদের পোশাক। আকাশযাত্রার টিকিট কিংবা ফার্নিচারের মতো আইটেমেরও বেচাকেনা বাড়ে ঈদে। সাধারণত পোশাক, প্রসাধনী ও বৈদ্যুতিক পণ্যকে ঈদ আইটেম হিসেবে গণ্য করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, এবার ঈদের বাজার ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার। এটি গত বছরের রোজার ঈদের চেয়ে কিছুটা কম। ওই ঈদে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়েছিল। সারাদেশের ৭০ লাখ দোকান থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ হিসাব করা হয়। সমিতির হিসাবমতে, শুধু রাজধানীতেই ছোট-বড় বিপণিকেন্দ্র প্রায় আড়াই লাখ এবং দোকান আছে ৬০ লাখের মতো।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, এবার ঈদে ব্যবসা পরিচালনা অনেকটাই মসৃণ ছিল। অন্যান্য বছররের মতো এবারে ঈদে বাজারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দিক থেকেও তেমন হয়রানি ছিল না। দেশী-বিদেশী পণ্যের শ্রেণিকরণ ছিল খুব সুস্পষ্ট। এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। যদি ভারতে আগের মতোই যাতায়াত সহজ হতো, তাহলে ঈদে দেশে বেচাবিক্রির পরিমাণ আরও কমে যেত। কারণ, কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনেকেই কেনাকাটা করে থাকেন। এবার কেনাবেচার পরিমাণ কম হওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আগে যে রকম মানুষের হাতে বাড়তি অর্থ থাকত, এবার সে সুযোগ তেমন ছিল না। তদুপরি যাদের বাড়তি টাকা থাকে, তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়তি কেনাকাটা করে থাকেন। আবার বেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই বেতন ও বোনাস হয়েছে।
এবারের ঈদে দেশীয় অনেক বস্ত্র ও পোশাক ভারতীয় ও পাকিস্তানি নামে বাজারে বিক্রি হয়েছে। আবার বিদেশী কিছু পণ্য ঈদকে টার্গেট করে এবার অনেকটা আগেভাগেই দেশের বাজারে ঢুকেছে। এ কারণে দেশীয় বস্ত্র ও পোশাক বিক্রির পরিমাণ অন্তত ২০ শতাংশ কম হয়েছে। জানতে চাইলে বেসরকারি বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক এবং লিটিল গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশে এবার ঈদের মানুষের মনোভাবকে পুঁজি করেছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। ভারত থেকে আনা বস্ত্র ও পোশাক পাকিস্তানি বলেও চালিয়ে দেওয়ার খবরও আছে। আবার দেশীয় বস্ত্র ও পোশাককেও পাকিস্তানি পণ্য দাবি করে দ্বিগুণ দাম রাখা হয়েছে। দেশীয় বস্ত্র ও পোশাকের মধ্যে কোনো কোনো আইটেমের মান ভারত, পাকিস্তান কেন– যে কোনো দেশের একই আইটেমের চেয়ে ভালো। এ কারণেই দেশীয় পণ্যকে বিদেশী বলে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। তাঁর মতে, দেড় লাখ কোটি টাকার এবারের ঈদবাজারের মধ্যে শুধু বস্ত্র ও পোশাকের পরিমাণ হবে অন্তত ৮৫ হাজার কোটি টাকার। সারা বছর দেশীয় বস্ত্র এবং পোশাকের বাজারের আকার ১২ বিলিয়ন ডলার। এর একটি অংশই ঈদকেন্দ্রিক। পাজামা, পাঞ্জাবি, শাড়ি, লুঙ্গি, শার্ট, গেঞ্জিসহ পরিধেয় সব বস্ত্র ও পোশাকই রয়েছে এর মধ্যে।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা