
উচ্চ অগ্নিদুর্ঘটনা কবলিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। এর জন্য দায়ী নগর পরিকল্পনা ব্যবস্থা। প্রতি বছরই রাজধানীর পুরান ঢাকা এলাকা, সিদ্দিকবাজার, চকবাজার, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিসংযোগের কথা শোনা যায়। এ বছর শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই বেড়েছে আগুনের ভয়াবহতা। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিকাণ্ডে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে শিল্প-কারখানা, বস্তি এলাকা, কেমিক্যাল গোডাউন, নদী বন্দর, অপরিকল্পিত ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ফলে প্রতি বছর মালিকপক্ষকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিটি দুর্ঘটনাই বয়ে আনে অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু কেন হচ্ছে এমন? আমাদের সক্ষমতার অভাব, নাকি পরিকল্পনার ঘাটতি? কিছুদিন আগে আমেরিকার লস এঞ্জেলস ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই অগ্নিকাণ্ড মানুষ, সম্পত্তি এবং পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। কিছু ক্ষেত্রে এর ফলে ঘটে যাওয়া ক্ষয়ক্ষতি হয় অপূরণীয়। যার ফলে শত শত মৃত্যু, সম্পত্তি এবং জিনিসপত্রের ব্যাপক ক্ষতি এবং পরিবেশের ওপর যার উল্লেখযোগ্য প্রভাব পরে। পরিবারের অর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে কারখানায় যাওয়া শ্রমিকটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে। ভেঙে পড়ছে একটি পরিবার। যার প্রভাব পড়ছে ব্যক্তিগত জীবনে।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ দর্শাতে গিয়ে প্রথমেই যে বিষয়গুলো সামনে আসে তা হলো বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, গ্যাসের পাইপলাইন লিকেজ, গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের অভাব ইত্যাদি। এ সকল বিষয় সবার জানা থাকলেও নেই সচেতনতা। ফলে হচ্ছে পুনরাবৃত্তি, বাড়ছে প্রাণ ও সম্পদহানি। অগ্নিকাণ্ডের প্রায় ৪০ শতাংশ ঘটে থাকে চুলার আগুন ও বৈদ্যুতিক কারণে। অগ্নিকাণ্ডের কারণের মধ্যে অন্যতম হলো অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থার অপ্রতুলতা। অগ্নিনির্বাপণে প্রয়োজন অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই তা অনুপস্থিত। রাজধানীতে আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা সরগরম। কিন্তু এ সকল ভবনে জরুরি নির্গমন পথ না থাকায় আগুন লাগলে মানুষের বের হওয়ার উপায় থাকে না, হয় জানের ক্ষতি। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার কথা সবারই জানা। এছাড়া পেট্রোল পাম্পে গাড়ি রিফিল করার সময়ও অহরহ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।
সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কিছু দুর্ঘটনা যেমন- সাভারে বস্তিতে আগুন, গাজীপুর অ্যালুমিনিয়াম কারখানায় আগুন, আশুলিয়ায় ঝুটের গুদামে আগুন, চট্টগ্রামের আমিনবাজার কাঁচা বাজারে আগুন, কিছুদিন আগে দেশের অন্যতন পর্যটন কেন্দ্র সাজেকের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক। পরিসংখ্যান বলে, ২০১৮ সালে ঢাকা শহরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ২ হাজারের বেশি। ২০২২ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ২৪ হাজারের ঊর্ধ্বে এবং ২০২৩ সালে দুর্ঘটনা ২১ হাজারের বেশি। ২০২১ সালে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ২২ হাজার ২২২টি এবং এতে মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজার ৫৮০।
অসাবধানতাই অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম কারণ। তাই অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। ত্রুটিযুক্ত বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকা, রান্নার পর ভালোমতো চুলা বন্ধ করা, ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা রাখা, কলকারখানার আশপাশে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা রাখা, গুদামঘর ও কারখানায় ধূমপান নিষিদ্ধ করা, মশার কয়েল ও সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ নিভিয়ে নিরাপদ দূরত্বে ফেলা। এ ছাড়া শিল্পক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের আগুন লাগলে প্রাথমিক করণীয় বিষয়গুলো প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। শিল্পকারখানার ভবন তৈরির সময় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার ও জরুরি নির্গমন পথের ব্যবস্থা রাখা।
আবাসিক এলাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন বন্ধ করতে হবে। বিশেষত প্লাস্টিক, তৈল ও দাহ্যজাতীয় প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন কোনো অবস্থায় আবাসিক এলাকায় দেওয়া যাবে না। রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে হাজার হাজার বিভিন্ন প্রকারের ছোট বড় কারখানা, বাসাবাড়ির আঙিনায় গড়ে তুলে ব্যবসা করতে দেখা যায়। এসব কারখানা কীভাবে অনুমোদন পায় সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। বিল্ডিং কোড, সিডিএ, সিটি করপোরেশনের অনুমোদন ছাড়া বহু বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। এসব বিল্ডিং কীভাবে অনুমোদন ছাড়া তৈরি হয় সেটাও বোধগম্য নয়। বিল্ডিংয়ের নকশা অনুমোদন সব ঠিকঠাক রেখে বিল্ডিং ঘরবাড়ি না করার অভিযোগ অনেক পাওয়া যায়। এসব কারণেও অগ্নিকান্ডের ফলে প্রাণহানি বেশি হচ্ছে। একটা বিল্ডিং থেকে আরেকটা বিল্ডিংয়ের দূরত্ব, রাস্তা, গাড়ি চলাচলের প্রয়োজনীয় রাস্তা রাখা এসব বিল্ডিং কোডে বিবেচনা ও শর্ত দেয়া থাকলেও অনেকাংশে তা মানা হচ্ছে না। ফলে অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করছে। প্রশাসনকে এসব বিষয় খতিয়ে দেখে জননিরাপত্তায় কঠোর হতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে অব্যাহত আগুন লাগার সঠিক কারণ নির্ণয় করতে হবে। অগ্নিকাণ্ড এড়াতে প্রয়োজন সতর্কতা। আর সতর্ক থাকলে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব অনেকাংশে।
অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ করতে দেশের প্রতিটি মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিহত করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ