ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

সামাজিক বৈষম্য ও আমাদের দায়িত্ব

হৃদয় পান্ডে

প্রকাশিত: ১৯:২০, ১০ এপ্রিল ২০২৫

সামাজিক বৈষম্য ও আমাদের দায়িত্ব

মানুষ সামাজিক জীব। একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে, পারস্পরিক সহায়তায় একটি সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ে তোলে বলেই মানব সভ্যতা এত দূর এগিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই সমাজেই আজও গভীরভাবে রয়ে গেছে বৈষম্যের শিকড়। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহর-গ্রাম কিংবা নারী-পুরুষ- প্রায় প্রতিটি স্তরেই এক ধরনের বৈষম্য আমরা দেখতে পাই। সমাজে যখন কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভোগে মগ্ন, তখন অন্য কেউ হয়তো ন্যূনতম চাহিদার জন্য হাহাকার করছে। এই বৈষম্য শুধু আয় বা সম্পদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি প্রসারিত হয়েছে শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক মর্যাদা এবং এমনকি ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও। অথচ একটি সভ্য সমাজ গঠনের মূল ভিত্তিই হলো ন্যায্যতা এবং সাম্য। সামাজিক বৈষম্য শুধু সমাজের সৌন্দর্যই নষ্ট করে না, এটি মানুষের মধ্যে হিংসা, ক্ষোভ এবং অসন্তোষের জন্ম দেয়- যা এক সময় সামাজিক অস্থিরতার রূপ নেয়। এই বাস্তবতায় আমাদের প্রশ্ন করা দরকার- বৈষম্য কিভাবে গড়ে ওঠে? এটি টিকিয়ে রাখতে কারা ভূমিকা রাখে এবং আমরা কিভাবে এটি মোকাবিলা করতে পারি?
সামাজিক বৈষম্যের রূপ :
সামাজিক বৈষম্য কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা নয়। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা একটি নির্মম বাস্তবতা। উপনিবেশিক শাসন, জমিদারি প্রথা, শ্রেণি ব্যবস্থার মতো বহু পুরনো কাঠামো আজও বিভিন্ন রূপে সমাজে বিদ্যমান। নতুন করে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক পক্ষপাত ও অর্থনৈতিক বৈষম্য। এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, তা অনেক সময় মানসিক ও সাংস্কৃতিক জায়গাতেও প্রভাব ফেলে। একজন শহুরে ধনী ব্যক্তি হয়তো তার সন্তানকে বিশ্বমানের শিক্ষা ও সুযোগ দিতে পারেন। যেখানে একটি গ্রামীণ পরিবারের সন্তান হয়তো প্রাথমিক শিক্ষার জন্যও সংগ্রাম করছে। একইভাবে সমাজের এক শ্রেণি হয়তো আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরেক শ্রেণি আজও ইন্টারনেট কী তা জানে না। এই ব্যবধান ধীরে ধীরে সমাজে এক ধরনের অলিখিত দেয়াল তৈরি করে। যেখানে একদিকে অভিজাত শ্রেণির উঁচু টাওয়ার, অন্যদিকে সুবিধাবঞ্চিতদের অতি সাধারণভাবে বাঁচার চেষ্টা। এই বৈষম্য এতটাই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে যে, অনেক সময় আমরা একে স্বাভাবিক ধরে নেই। এখানেই বিপদ। কারণ, যে বৈষম্যকে সমাজ স্বাভাবিক ভাবতে শেখে, তা থেকেই জন্ম নেয় দীর্ঘমেয়াদি বিভেদ ও বৈরিতা।
বৈষম্যের প্রভাব ও সামাজিক পরিণতি :
সামাজিক বৈষম্যের প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এটি শুধু আর্থিকভাবে দরিদ্র মানুষদের সুযোগ কমিয়ে দেয় না, তাদের স্বপ্ন দেখা, আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচা এবং সম্মান পাওয়ার অধিকারকেও ক্ষুণ্ন করে। একটি সমাজে যখন একটি বড় অংশ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন সেই সমাজের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়। মানুষ ধীরে ধীরে আইনের প্রতি বিশ্বাস হারায়। অপরাধের প্রতি সহানুভূতি বাড়ে এবং হিংস্রতা ও উগ্রতা সমাজে জায়গা করে নেয়। তরুণরা যখন দেখে তাদের প্রতিভা কিংবা শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না, তখন তারা হতাশায় ডুবে যায় কিংবা ভুল পথে চলে যায়। সমাজে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক ধরনের ‘দুই পৃথিবী’- একটি সুযোগে ভরপুর, আরেকটি বঞ্চনায় নিমজ্জিত।
সমতার সমাজ গঠনে আমাদের পথচলা :
সামাজিক বৈষম্য  আমাদের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটগুলোর একটি। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি নৈতিক ও মূল্যবোধেরও সংকট। একটি সভ্য সমাজের পরিচয় তার দুর্বলতম নাগরিক কিভাবে জীবনযাপন করছে, তা দিয়ে নির্ধারিত হয়। তাই এই বৈষম্য দূর করতে হলে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে পথ চলতে হবে। রাষ্ট্রের সদিচ্ছা, সুশাসন, শক্তিশালী নীতি এবং নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা- এই চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েই সম্ভব একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন। মনে রাখতে হবে, পরিবর্তন কখনোই বাইরে থেকে আসে না- এটি জন্ম নেয় প্রত্যেক মানুষের ভেতর থেকে। আমরা যদি সত্যিই চাই একটি বৈষম্যহীন সমাজ, তাহলে আজই আমাদের চিন্তা ও আচরণে সেই সমতার বীজ বপন করতে হবে। কেননা, একটি শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন তখনই পূর্ণতা পায়, যখন আমরা সকল মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখতে শিখি।

 লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

×