ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

ট্রাম্পের শুল্কারোপ অস্থিতিশীল করবে বিশ্ববাণিজ্য

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ৯ এপ্রিল ২০২৫

ট্রাম্পের শুল্কারোপ অস্থিতিশীল করবে বিশ্ববাণিজ্য

ডোনাল্ড ট্রাম্প

বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্কারোপ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই তালিকায় আছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশী পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশী পণ্যের ওপর আগে যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত গড়ে শুল্ক ছিল ১৫ শতাংশ। সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে প্রায় ১০০টি দেশের ওপর নতুন করে শুল্কারোপের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

মার্কিন অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য অন্যান্য দেশের ওপর ‘ন্যূনতম ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্ক’ ঘোষণা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, যা ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। এ ছাড়াও ৯ এপ্রিল থেকে আরও প্রায় ৬০টি দেশের ওপর উচ্চতর শুল্ক আরোপ শুরু হবে। এই দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্কারোপ করেছিল। অন্যদিকে বিদেশে প্রস্তুতকৃত অটোমোবাইলের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কারোপ শুরু হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হলেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত সব দেশের পণ্য আমদানিতে ২০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। ঢালাওভাবে বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর শুল্কারোপের কারণস্বরূপ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বাজেভাবে’ ব্যবহার করেছে এবং আমেরিকান পণ্যের ওপর অসম শুল্কারোপ করেছে।
সেই বহুল আলোচিত ঘোষণা দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যে ঘোষণার মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা করবেন বলে এতদিন ধরে নানা আওয়াজ তুলেছেন। সেই রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্কের ঘোষণা অবশেষে দিলেন তিনি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ট্রাম্প এই ঘোষণা দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি অত্যস্ত বস্তুনিষ্ঠ।

এত দিন ধরে শুল্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত যত অঙ্গীকার করেছেন তার প্রায় শতভাগ তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। প্রথম জমানায় যেমন করেছেন। তেমনি দ্বিতীয় জমানায়ও করছেন; এ ধারা চলতি জমানায় অব্যাহত থাকবে বলেই  ধারণা করা যায়।
যে দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যে যতটা শুল্ক চাপিয়ে থাকে, ২ এপ্রিল থেকে সেই দেশের পণ্যে পাল্টা এর উপযুক্ত হারে শুল্কারোপের কথা জানিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। দিনটিকে আগেই আমেরিকার ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি। গত ১ মার্চ আমেরিকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী বিকেল ৪টায় (বাংলাদেশের রাত দুইটা) এই ‘পাল্টা’ বা ‘পারস্পরিক শুল্ক’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেখানে তিনি যা যা বলেন তা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রীতিমতো বোমাবর্ষণের শামিল।
কথা ছিল, যে দেশ মার্কিন পণ্যে যত শুল্কারোপ করে সেই দেশের পণ্যে ঠিক ততটাই শুল্কারোপ করা হবে। ঘোষণায় ট্রাম্প বলেন, ‘আমি তা করতে পারতাম; কিন্তু তাতে অনেক দেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে।’ চীনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, চীন মুদ্রা কারসাজিসহ বাণিজ্যবাধা- সব মিলিয়ে মার্কিন পণ্যে ৬৭ শতাংশ শুল্কারোপ করে।

যুক্তরাষ্ট্র করবে তার প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ৩৪ শতাংশ। সব দেশের বেলায় কমবেশি এই নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। ফলে এ ঘটনায় বিপর্যস্ত হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন ট্রাম্প। সব দেশের পণ্যেই গড়ে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। এখন দেখতে হবে, বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের ওপর ঠিক কী হারে শুল্কারোপ করা হয়েছে। বিষয়টি হলো ভিয়েতনাম, চীন ও কম্বোডিয়ার শুল্ক বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হবে। সে কারণে হয়তো আরএমজি শিল্প অতটা আক্রান্ত হবে না, এমন ধারণা কেউ কেউ করছেন।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগীদের মধ্যে তুরস্কের ওপর ১০ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৭ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ৩০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ওপর ৪৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ ও কম্বোডিয়ার ওপর ৪৭ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের ওপর শুল্ক আমাদের চেয়ে কম। এই ফাঁকে ভারত হয়তো লাভবান হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মূল্যবৃদ্ধির কারণে মার্কিন ভোক্তারা এমনিতেই কিনবে কম। এর জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবাই।
তবে শুল্কের হিসাবে ফাঁকি আছে। ধরা যাক, বাংলাদেশে বানানো বড় কেনো ব্র্যান্ডের শার্ট যুক্তরাষ্ট্রের দোকানে এতদিন ২০ ডলারে বিক্রি হতো। বাংলাদেশের গার্মেন্টস কোম্পানি থেকে সেই শার্ট হয়তো কিনছে পাঁচ ডলার ইউনিট প্রাইসে (বা ক্রয়মূল্যে)। শুল্কের হিসাবের ফাঁকটা হলো, এটি আরোপ করা হয় বন্দরে আমদানির সময়ের ক্রয়মূল্যের ওপর, বাজার মূল্যের ওপর নয়।

এখন হিসাব করলে দেখা যাবে, সেই পাঁচ ডলারের শার্টের ওপর আগে শুল্ক আসত ৭৫ সেন্ট, এখন আসবে ২ ডলার ৬০ সেন্ট। আগের চেয়ে বেশি দিতে হবে ১ ডলার ৮৫ সেন্ট। ফলে ২০ ডলারের ওই শার্টের দাম প্রায় দুই ডলার বাড়িয়ে সেই ব্র্যান্ড অনেকটাই সামাল দিতে পারবে।
আরেকটি সুবিধা হলো, বাংলাদেশ মূলত মধ্যম ও কম দামের পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে বিক্রি হয়। অন্যদিকে ভিয়েতনাম, চীন বা এমনকি ভারত এখন উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানি করছে। ফলে তারা যতটা আক্রান্ত হবে, বাংলাদেশ ততটা হবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তারপরও অনেকে বলছেন, বাংলাদেশের উচিত মার্কিন পণ্যের শুল্ক কমানো।

সেটা হলে আমাদের পণ্যে মার্কিন শুল্ক কমে যাবে। বাংলাদেশের উচিত, মার্কিন পণ্যের ওপর প্রচলিত শুল্কের হার ৭৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা। এর ফলে বাংলাদেশী পণ্যে মার্কিন শুল্ক হবে ১৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে সেখানে রপ্তানি যোগ-বিয়োগ এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই প্রক্রিয়ায় আমরা লাভবান হতে পারি।
বিশ্ব দেখেছে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাল্টা (রেসিপ্রোকাল) শুল্কারোপের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন, যা দীর্ঘদিন ধরে এঅঞঞ/ডঞঙ কাঠামোর মূল স্তম্ভ হিসেবে থাকা ‘সর্বাধিক অনুকূল দেশ’ (গঋঘ) নীতির সমাপ্তি বা অন্তত উল্লেখযোগ্য রূপান্তরের সংকেত বহন করছে। এই নীতির ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকার।

কারণ বিভিন্ন মার্কিন বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর ভিন্ন ভিন্ন পারস্পরিক শুল্কহার আরোপিত হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট পণ্যের ক্যাটাগরির ওপর শুল্কের হারও পরিবর্তিত হচ্ছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বিজয়ী ও পরাজিত দেশ নির্ধারণ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশ আরও অস্থির ও অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশসহ অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই পরিবর্তন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কারণ, তারা এমন এক অনিশ্চিত ব্যবস্থায় কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। এই নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বাংলাদেশকে তার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যনীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সংস্কারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।

মূল বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক শক্তিশালী করতে হবে। যাতে বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান নিরাপদ থাকে। আশা করা যায় যে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এ বিষয়ে একটি ইতিবাচক সমাধান করবেন। তিনি ইতোমধ্যে উপদেষ্টা পরিষদসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মার্কিন প্রেসিন্ডেটের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠিও পাঠিয়েছেন।

লেখক : সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

×