
টরেন্টোর চিঠি
Edward S. Herman এবং Noam Choms শু’র বই Manufacturing Content বইটি নিয়ে সম্প্রতি আলোচনার সুযোগ হয়েছিল কানাডার সুধী সমাজের মাঝে। আলোচনা সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার টরোন্টোর চিঠির পাঠকদের সঙ্গেও চুম্বক অংশ ভাগ করে নিতে চাই।
বইয়ের নামের পরে ছোট্ট করে লেখা আছে The Political Economy of Mass Media. অর্থাৎ, লেখকদ্বয় মিডিয়াকে পলিটিক্যাল ইকোনোমির আঙ্গিকে দেখতে চাইছেন। পলিটিক্যাল ইকোনোমি কী সে বিষয়ে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা আছে কিনা সেটি আলোচনাসাপেক্ষ। তবে আমার বরাবরই মনে হয়েছে যখন কোনো বিষয়ের জটিলতা এতটাই গভীর যে সেটি আর বিষয়ভিত্তিক থাকছে না, তখনই আমরা পলিটিক্যাল ইকোনমির অবতারণা করি।
এই আলোচনায় লেখকদ্বয় মূলত গণমাধ্যমকে অর্থনীতি এবং রাজনীতির আলোকে ব্যবচ্ছেদ করতে চেয়েছেন এবং তাদের এই চাওয়ার যৌক্তিকতাও অস্বীকার করবার জো নেই। আমরা যদি বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখব অর্থ এবং রাজনীতির প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যম নেই। এটি থাকা সম্ভবও নয় হয়ত। প্রকাশনা শিল্প অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সেখানে পত্রিকায় কেবল খবর প্রকাশ করে কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক-সিনেমা দেখিয়ে ব্যবসা করা অসম্ভব। সে কারণে প্রকাশনায় অর্থের সংশ্লেষ থাকে, থাকে বিজ্ঞাপনের আধিক্য, মালিকানার দ্বন্দ্ব।
হারম্যান এবং চমস্কি ছাড়াও গণমাধ্যম নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন আরও ক’জন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাদের কেউ কেউ শিক্ষকতা পেশায়ও জড়িত ছিলেন। হারম্যান এবং চমস্কি তাদের প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার বইতে যে কথাটি বলতে চেয়েছেন সেটি হচ্ছে, মিডিয়া সমাজে মূলত ধর্নাঢ্য ও ক্ষমতাবানদের স্বার্থকে চরিতার্থ করে।
অন্যদিকে উধষষধং ঝসুঃয তার বিশ্লেষণে দুটি ধারণা নিয়ে আলাপ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যারা পাঠক বা দর্শক তারাই মূলত পণ্য, সংবাদপত্র বা টেলিভিশন চ্যানেল নয়। আমরা নিজেদেরই নিজেরা বিক্রি করি এবং পণ্য হিসেবে আমাদের কিনে নেয় করপোরেট হাউসগুলো। বিষয়টি চিন্তার উদ্রেক করে এবং চিত্তাকর্ষকও বটে। ভেবে দেখুন কথাটির যৌক্তিকতা। আমরা আমাদের জীবনে যা ধারণ করি, মিডিয়া আমাদের কাছে সেটিই উপস্থাপন করে।
এ বিষয়ে ক্যানাডিয়ান সাংবাদিক ও সংগঠক শওগত আলী সাগর একটা চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কানাডার বাইরে আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও অভ্যন্তরে গত প্রায় ৪-৫ বছর ধরে তিনি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাতে শুরু করেন। এই সময় তিনি খেয়াল করেন কানাডার একটি জনপ্রিয় পত্রিকা The Globe And Mail নিয়মিত মার্ক কার্নিকে লিবারেল পার্টির বিকল্প নেতা হিসেবে আলোচনায় নিয়ে আসে।
মার্ক কার্নি কখনো সক্রিয় রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতিতে ছিলেন না। একজন অর্থনীতিবিদ এবং অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কানাডা এবং ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় প্রধান ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পদে তিনি ছিলেন খুব কঠিন কিছু সময়ে। যেমনÑ মার্ক কার্নি ব্যাংক অব কানাডার দায়িত্বে ছিলেন ২০০৮ সালের মন্দার সময়ে এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের দায়িত্বে ছিলেন ব্রেক্সিটের সময়, যখন ইংল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসে।
এই দুটো দায়িত্বে তার সমালোচনা নেই এমন নয়, কিন্তু প্রশংসাই বেশি। এখানে শওগত আলী সাগর যেটি বলেছেন, আমরা মার্ক কার্নিকে একজন স্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখলেও, তাকে আসলে করপোরেট হাউসগুলো রাজনীতিতে বসিয়েছে কিনা সেটি ভাববার বিষয়। যেহেতু তিনি নিজেও অত্যন্ত ধনী এবং সারা জীবন কাজ করেছেন পুঁজিবাদী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানে, তাই মার্ক কার্নি কানাডার মতো একটি ধনী রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান হলে সেটি বিশ্বব্যাপী বড় করপোরেট হাউসগুলোর জন্য সুবিধাজনক হতে পারে।
আমরা কয়েক বছর ধরে ঞযব এষড়নব অহফ গধরষ সহ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা কিংবা প্ররোচনায় মার্ক কার্নির ভক্ত হয়ে গেছি কিনা সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। যদি এই অনুমানটি সত্য হয় তাহলে ডালাস স্মিথের থিওরি অনুযায়ী এখানে আমরা অর্থাৎ, ভোক্তারাই একেকজন পণ্য। অন্যদিকে ডালাস স্মিথ আরেকটি চিন্তার উদ্রেক ঘটিয়েছেন যেটিকে তিনি আগের ধারণা অর্থাৎ, ‘Audence Commodity’ থেকে আলাদা করে বলছেন ‘Attentive capacity’।
যদি সহজ করে বলি তাহলে চিন্তা করে দেখুন আপনি যে ফেসবুকে ছোট ছোট ভিডিও দেখেন, যাকে ফেসবুক নাম দিয়েছে ৎববষং, সেটি আমার কৌতূহলকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে আপনার পছন্দের ভিডিও আপনাকে দেখায়। কানাডার একজন ফটো সাংবাদিক সাইমুম সায়ীদ আমাকে বলেছিলেন তিনি যেহেতু ইয়োগা, manifestation ইত্যাদি বিষয়ে কৌতূহলী, তাই তার ফেসবুক রিলসে তিনি কখনো রাজনৈতিক কোনো ভিডিও দেখেন না।
তার কাছে রিলস ক্রমাগত তার পছন্দের বিষয় তুলে ধরে। আপনি যদি পোষা প্রাণী ভালোবাসেন তাহলে দেখবেন ফেসবুক রিলস আপনাকে কেবল ওই বিষয়ের রিলস দেখাচ্ছে। অর্থাৎ, আপনার attentive capacity বিশ্লেষণ করে মিডিয়া আপনাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে।
Herbert Schiller -এর দর্শন আলোচনার সময় বলেছি যে, পশ্চিমা মিডিয়া বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়া অনেক সময় চায় তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বাকি বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিতে। অন্যদিকে Stuart Hall বলেছেন যে, সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক মিডিয়া তথ্যের বিস্তার এমনভাবে ঘটায় যেটার ব্যাখ্যা নির্ভর করে ভোক্তার ওপর।
অর্থাৎ, তারা তাদের খবর, সিনেমা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে তাদের চলমান আগ্রহের বিষয়বস্তু ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়। সেটি হতে পারে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতবাদের বিরোধিতা কিংবা কোনো সাংস্কৃতিক অবস্থানের পক্ষে জোরালো অবস্থান। উদাহরণ হিসেবে আপনি দেখতে পারেন সারা বিশ্বে সমকামিতার প্রচারে পশ্চিমা বিশ্বের খবর, সিনেমা ইত্যাদির ভূমিকা।
একটি জিনিস মনে রাখা জরুরি, আমরা যখন কোনো তাত্ত্বিক আলোচনায় থাকি তখন আমাদের নিজেদের অবস্থান সেখানে মুখ্য থাকে না, গৌণ হয়ে যায়। যখন এই বইটি আলোচনা করেছি তখন আমিও সেই বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। এখন যদি আমাকে বলতে বলা হয় যে, পুরো বইটিতে হারম্যান এবং চমস্কি আসলে কী বলতে চেয়েছেন আপনি মূল উপজীব্যগুলো তুলে ধরুন, তাহলে আমি সংক্ষিপ্তভাবে ৫টি বিষয় যেটি তারাই চিহ্নিত করেছেন, সেটি উল্লেখ করতে চাই। তারা বলেছেন, মিডিয়া যে সবসময় সত্য বলে, এটি সত্য নয়।
আবার মিডিয়া যে সবসময় মিথ্যা বলে সেটিও সত্য নয়। তাহলে মিডিয়া কী বলে, কীভাবে বলে, কেন বলে সেটিই এই বহুল আলোচিত বইটির উপজীব্য বিষয়। হারম্যান এবং চমস্কি বলছেন যে, মিডিয়া মূলত মালিকের কথা বলে। তারা পয়সার পক্ষে কথা এবং মুনাফার কথা বলে। আমাদের মনে রাখতে হবে তারা এই বইটি লিখেছেন ১৯৮৮ সালে যখন বিশ্ব শীতল যুদ্ধের শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে।
যদিও তারা এই বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন আরও বহু আগে, মূলত ১৯৭০ সালের দিক থেকেই। কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনার যৌক্তিকতা আজও প্রাসঙ্গিক এবং বইটি বিশ্বের বহু শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অবশ্যপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। হারম্যান এবং চমস্কি আরও বলেছেন যে, মিডিয়াকে মূলত বিজ্ঞাপনদাতার পয়সায় চলতে হয়। ফলে তাদের স্বার্থ রক্ষা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কোনো উপায় থাকে না।
এছাড়াও মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা তাদের ব্যবসায়িক মডেল নির্ধারণ করে, সেটি হচ্ছে সংবাদ সংগ্রহের মাধ্যম। একটি পত্রিকার পক্ষে সারা দেশের সব জায়গায় তাদের রিপোর্টার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নির্ভর করতে হয় সরকারি প্রচার মাধ্যম, করপোরেট বা গোয়েন্দা মাধ্যমের তথ্যের ওপর। যেমন আমি উল্লেখ করছিলাম ইরাক যুদ্ধের সময় আমরা বাংলাদেশ থেকে এই যুদ্ধের তথ্য পেয়েছিলাম সাংবাদিক আনিস আলমগীরের মাধ্যমে চ্যানেল আই দেখে।
কিন্তু অনেক পশ্চিমা দেশই তখন হোয়াইট হাউস, পেন্টাগণ ইত্যাদি সরকারি মাধ্যমের তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। যেহেতু এসব মাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হয়, তাই অনেক সময় তাদের বিরুদ্ধে কোনো খবর করা যায় না। খেয়াল করুন ইসরাইল যে গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে সে সংবাদ তুলে ধরত বলে আল-জাজিরাকে ইসরাইলের অভ্যন্তরে তাদের সরকার নিষিদ্ধ করেছে। এমন হাজার হাজার উদাহরণ আছে বিশ্বব্যাপী।
এখন এই আলোচনার পরিধি বাড়াতে গেলে বলতে হয় মিডিয়া কী বলে আর মানুষ কী বিশ্বাস করে সেটিকে কেন্দ্র করে বর্তমান বিশ্ব আবর্তিত হচ্ছে। আপনি আমি যেই মতবাদের পূজারি। আমরা শুধু সেই সংক্রান্ত তথ্যগুলোই গ্রহণ করি, আর ভিন্নমতকে প্রত্যাখ্যান করি। ভিন্ন মত শুনে, বুঝে, যাচাই করে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার মতো মানুষের সংখ্যা খুব কম।
হারম্যান এবং চমস্কি তাদের বইতে যে ৫টি সূচকের মাধ্যমে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন তার কেন্দ্রে আছে ঞযব চৎড়ঢ়ধমধহফধ গড়ফবষ. তারা বলছেন, সত্য কী তার কোনো সুনির্দিষ্ট ভিত্তি নেই। সত্য অন্য অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমনÑ ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে মিডিয়া মূলত শ্রমজীবী মানুষের কথা বলতে চাইত। চাইত তারা পুঁজিবাদী সমাজকে ভেঙে নিজেদের অধিকার বুঝে নিক।
রাষ্ট্র, প্রশাসনযন্ত্র, বণিকদের একচ্ছত্র আধিপত্য ভেঙে শ্রমজীবী মানুষ যাতে তথ্য পাওয়ার একটা সুযোগ পায় তাই গণমাধ্যমের যাত্রা ওই সময়টায়। কিন্তু পরবর্তীতে নিরপেক্ষ মিডিয়ার শক্তি বুঝতে পেরে বুর্জোয়া শ্রেণি মিডিয়াগুলো কিনে নিতে থাকে এবং একসময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকের বেশি পত্রিকা, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন চ্যালেন, চলচ্চিত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে ওঠে মাত্র ২৯টি প্রতিষ্ঠান বা পরিবার।
আমরা যদি অইঈ পযধহহবষ এর কথা চিন্তা করি, এর মালিক হচ্ছে Disney’s এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই তাই অইঈ’কে শ্রম-রাজনীতি, পরিবেশ কিংবা ট্যাক্সবিষয়ক জিনিসপত্র নিয়ে খবর কমই দেখা যায়। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি প্রভাবশালী পত্রিকা The Washington Post কয়েক বছর আগে কিনে নেন পৃথিবীর অন্যতম ধর্ণাঢ্য ব্যক্তি Amayon এর প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক Jeff Beyos. এখন অসধুড়হ শ্রমিকদের সংগঠন করায় বিশ্বাসী নয়।
আর যেহেতু কানাডার কুইবেক প্রদেশে শ্রমিকদের সংগঠন ছাড়া ব্যবসা করা যায় না, তাই আমাজন সেখান থেকে সরে এসেছে। তারা শ্রমিকদের সংগঠন করতে দেবে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই ওয়াশিংটন পোস্ট এই বিষয়ে সোচ্চার নয়, যদিও সাংবাদিকতায় উৎকর্ষের জন্য ঞযব ঘবি ণড়ৎশ ঞরসবং এর পর তারাই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছে।
মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের প্রভাব উল্লেখ করতে গিয়ে হারম্যান এবং চমস্কি বলেছেন, ১৯৬০-৬৭ সালের মধ্যে সোশাল ডেমোক্রেটিক প্রেস হিসেবে পরিচিত উধরষু ঐবৎধষফ, ঘবংি ঈযৎড়হরপষবং, ঝঁহফধু ঈরঃরুবহ এর মতো সংবাদ মাধ্যমগুলোর দৈনিক ক্রেতা ছিল প্রায় ১ কোটির মতো। যার মধ্যে ডেইলি হেরাল্ডের ক্রেতাই ছিল প্রায় ৪৭ লাখের মতো। তাদের ক্রেতার সংখ্যা দ্য টাইমস, দ্য ফাইনান্সিয়াল টাইমস, গার্ডিয়ানের সব ক্রেতার চেয়েও বেশি ছিল।
অথচ বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির দিকে ৮ শতাংশের বেশি ক্রেতা ও পাঠক থাকা সত্ত্বেও তারা পেত মাত্র ৩ শতাংশ বিজ্ঞাপন। সানডে টাইমসের তুলনায় তারা বিজ্ঞাপন পেত এক-দশমাংস, আর অবজারভারের তুলনায় এক-সপ্তমাংশ মাত্র। এটি মূলত লেবার পার্টি বা শ্রমজীবী মানুষের মুখপত্র হওয়ায় তাদের বঞ্চিত করার একটি কৌশল ছিল। আমরা যদি বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকাই ঈইঝ বিজ্ঞাপনদাতাদের তাদের ‘ঈষরবহঃ অঁফরবহপব চৎড়ভরষব’ দিয়ে সহায়তা করে, যাতে তারা তাদের বিজ্ঞাপনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করতে পারে।
এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা চলে টিভি চ্যানেল বা পত্রিকায় গাড়ি কোম্পানি এত বেশি বিজ্ঞাপন দেয় যে, মিডিয়া অনেক সময় স্বাধীনভাবে গাড়ির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ বা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংবাদ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কেননা, বিজ্ঞাপন ছাড়া পত্রিকা প্রকাশ ও টেলিভিশন চালানো বর্তমান বিশ্বে প্রায় অসম্ভব। একইভাবে কোকাকোলা বা নেসলের মতো কোম্পানি বোতলজাত পানি প্রস্তুত ও বিক্রি করার মাধ্যমে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করলেও যেহেতু তারা মিডিয়ায় প্রচুর বিজ্ঞাপন দেয়, এসব খবর করা মিডিয়ার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
ঠিক একইভাবে নানা সন্ত্রাসী কর্মকা-সহ সংবেদনশীল তথ্যের জন্য মিডিয়াকে নির্ভর করতে হয় সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উপরে। তাই তাদের নিয়ে স্বচ্ছ তথ্য প্রদান করা মিডিয়ার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এজন্য অনেক সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় কত সেটি পত্রিকা প্রকাশ করতে পারে না। বইয়ের এই পর্যায়ে এসে হারম্যান এবং চমস্কি ঋষধশ নামে একটি কৌতূহলোদ্দীপক সূচকের কথা বলেছেন, যেটি মূলত একটি এন্টি-এয়ারক্রাফট, এন্টি-ট্যাংক আর্টিলারি গান।
যেগুলো শত্রুর যুদ্ধ বিমান বা ট্যাংক প্রতিহত করে, ধ্বংস করে দেয়। এখানে হারম্যান এবং চমস্কি ফ্ল্যাক বলতে বুঝিয়েছেন ক্ষমতাধরদের প্রতিপত্তি নিয়ে। তারা আইন-আদালতের ফাঁক গলে, মামলা-হামলার হুমকি দিয়ে অনেক সময় মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করতে পারে। অনেক সময়ে এই কাজটি কৌশলেও করা হয়। যেমনÑ মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটি ছোট্ট সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সরকারের কোনো গোপন ষড়যন্ত্র বিষয়ক সংবাদ প্রকাশ বন্ধ করে দিতে পারে সামরিক বা বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা।
আবার অনেক সময় কোনো বড় করপোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের ক্ষতিকর কর্মকা-ের সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য শত শত কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের প্রতিশ্রুতি দেয় মিডিয়া হাউসগুলোকে। এছাড়া কালো আইনের মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিঘিœত করার উদাহরণ তো আমাদের কাছে আছেই।
এই প্রোপাগান্ডা মডেল কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিংশ শতাব্দীর নানা সময়ে পৃথিবীর নানা দেশে প্রয়োগ করেছে সেটি হারম্যান এবং চমস্কি বিভিন্ন যুদ্ধের উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছে। তবে সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে তারা সর্বশেষ যেই সূচক নিয়ে কথা বলেছেন সেটি হচ্ছে সাম্যবাদ-বিরোধিতা। যখন হারম্যান এবং চমস্কি বইটি লেখেন তখন পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর প্রধান শত্রু ছিল সাম্যবাদে বিশ্বাসী সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনের মতো রাষ্ট্রগুলো।
তাই তাদের দেশে প্রচলিত সাম্যতা ভিত্তিক সমাজ কিংবা কমিউনিজমকে ঠেকানোর জন্য তারা যত ধরনের প্রপাগান্ডা ছড়ানো দরকার, তার সবই করত। এই কমিউনিজম বিরোধী প্রপাগা-া মূলত পশ্চিম থেকে পূর্বে, তারপর ডানপন্থি রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বামúন্থি রাজনৈতিক অবস্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এখন এই বিরোধিতা বিভিন্ন নামে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমমনা বন্ধু রাষ্ট্রের বিরোধী শক্তিকে অনেক ক্ষেত্রেই সন্ত্রাসী রাষ্ট্র নাম দিয়ে ‘উচিত শিক্ষার’ ব্যবস্থা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের স্বৈরাচারী বা authoritarianism রাষ্ট্র হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় উগ্রবাদকে উস্কে দিয়ে, সেই সংক্রান্ত প্রপাগা-া ছড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্র আজকাল আমরা দেখতে পাই।
হারম্যান এবং চমস্কি রচিত Manufacturing Consent: The Political Economy of Mass Media নিয়ে আলোচনার সমাপ্তি টানতে হলে আমাকে বলতে হবে, যদিও এই বইয়ের সূত্রপাত ও ভিত্তি শীতল যুদ্ধ, কিন্তু এর প্রায়োগিক দিক আজও প্রাসঙ্গিক। যদি হারম্যান এবং চমস্কির বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝে থাকি তাহলে বলতে হয় ভেবে দেখুন আপনি এমন একটি দেশে বাস করেন যেটিতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রয়েছে।
আপনি যা ইচ্ছা পড়তে পারেন, যা ইচ্ছা দেখতে পারেন। আপনি মনে করেন যে, আপনি সব দেখে, যাচাই বাছাই করে নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আপনি বিশ্বাস করছেন যে, আপনি পৃথিবীকে যেমনটি দেখেন, এটি আসলে তেমনই। এখন হারম্যান এবং চমস্কি আপনাকে এই বইয়ের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করে বলছেন-
১) আপনি কি জানেন গণতন্ত্রে প্রোপাগাণ্ডা এমনভাবে ছড়ানো হয় যে, আপনি বুঝতেই পারেন না সেটি প্রোপাগাণ্ডা?
২) আপনি কি জানেন আপনি কি ভাববেন সেটি না জানিয়ে মিডিয়া আপনাকে আপনারই অজান্তে জানিয়ে দেয় আপনি কোন বিষয়ে ভাববেন?
৩) এবং আপনি কি জানেন যে, আদতে বর্তমান আধুনিক সংবাদ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে এটি আপনাকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছে যে, আপনি আসলে মুক্তচিন্তার অধিকারী, যেখানে এটি কৌশলে আপনার চিন্তাভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত করছে?
ভাবুন। হারম্যান এবং চমস্কি আপনাকে, আমাকে বলছে – ভাবুন।
এপ্রিল ৬, ২০২৫