
চিরচেনা রূপে
প্রতিবছর ঈদ এলেই বহু মানুষ ইট-পাথরের যান্ত্রিক শহর রাজধানী ঢাকা ছেড়ে ছুটে যান নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি। নিজ জন্মভূমিতে ঈদের উৎসব উদ্যাপনে পরিবার পরিজন নিয়ে যাত্রা করে সড়ক, নৌ ও আকাশপথে। ঈদ উপলক্ষে প্রতিটি পরিবারে বাড়তি যে আয় হয়, এর একটা বিশাল অংশ ব্যয় হয় যাত্রাপথে। যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়ের সুযোগে পরিবহন মালিকরা দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করে নেয়।
যাত্রীরাও অনেকটা জিম্মি। তারা সব বুঝেও থাকে নিশ্চুপ। চলতি মাসের ৪ তারিখে বরিশাল থেকে আসার পথে নন এসি বাসে নিয়মিত ভাড়া ৬শ’ টাকার পরিবর্তে ১ হাজার টাকা নিল। এতেও আমরা খুশি ছিলাম। কেননা, টিকিট পাওয়া ছিল খুবই দুষ্কর। জীবিকার তাগিদে কর্মস্থলে ফিরে আসা ছিল এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।
তবে একটি বিষয়ে আশ্চর্য হলাম, বাসটি যাত্রা শুরু করার দু-এক ঘণ্টা পরেই হঠাৎ থেমে গেল। জানতে পারলাম সামনে সেনাবাহিনী চেক করছে। এর কারণ, যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেছে কি-না, তা ধরা পরলেই জরিমানা গুনতে হবে। পরবর্তীতে গাড়ির গতিবেগে মনে হয়েছিল যেন হাওয়ার বেগে এগোচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় রাজধানীতে আসতে পেরেছি। মনে হলো, ঈদের তিনদিন পরেও কোলাহলশূন্য রাজধানী অপেক্ষমাণ তার চিরচেনা রূপের জন্য।
বরিশালে যাওয়ার স্মৃতিটা আরও ভয়াবহ। এসি বাস চলছে তার নিজস্ব গতিতে। মাঝপথে হঠাৎ সামনে একটি বাস গতিরোধ করে। কয়েকজন নেমে এসে ড্রাইভারের নাকে চোখে ঘুষি মারা শুরু করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা আবার চলে গেল। পরে জানতে পারলাম, পেছন থেকে কয়েকবার হর্ন দিয়েছে। সাইড দেয়নি, তাই এ প্রতিশোধ।
কম বয়সী কিছুটা ফ্যাশনেবল সেই বাসচালক হয়তো বুঝতে পারলে জানালার গ্লাস খুলত না। নাক দিয়ে পড়া রক্ত মুছতে মুছতে বাস চালিয়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাল। যাত্রীরা আল্লাহকে ডাকছিল ড্রাইভার যেন সুস্থ থাকে। আমরা সবাই কতটা স্বার্থপর! কিভাবে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাব সেটা নিয়েই চিন্তা। অথচ একবারও কেউ ভাবল না যে, ড্রাইভারকে নিয়ে কোনো হাসপাতালের সামনে কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার কথা। আমাদের আরও মানবিক হতে হবে।
নীরবতা যেন প্রতিনিয়ত মানবতার চোখ অন্ধ করে দিচ্ছে। প্রতিদিন রাস্তায় শতশত মানুষের অকালমৃত্যুর বড় কারণ পরিবহন খাতের নৈরাজ্য। ঈদের সময়ে প্রতিটি বাস যাত্রী নিয়ে কতবার আসা-যাওয়া করতে পারবে, তা নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। এতে দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে। অহেতুক প্রতিযোগিতার কবল থেকে যাত্রীরাও নিস্তার পাবে।
শহরের আর্থিক লেনদেন ঈদের পরের দিন কিছুটা থমকে গেলেও গ্রামেগঞ্জে এর রেশ থাকে প্রায় এক সপ্তাহ। ঈদ উপলক্ষে গ্রামীণ অর্থপ্রবাহ বাড়ে বিপুল পরিমাণে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ সাবলীলভাবে ঈদে সাহায্য করার জন্য শহরের কর্মজীবীদের কাছে হাত বাড়ায়। যা অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় থাকে না। কেননা, মানুষগুলোর সঙ্গে রয়েছে এক আত্মিক বন্ধন।
আবার বিত্তবানরা গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেন। এভাবে ঈদের পরেও নানাভাবে গ্রামে চলে আর্থিক লেনদেন। ঈদের একদিন পরে রাত আটটার সময়ে একটি মিষ্টির দোকানে গিয়ে দেখলাম রসমালাই বিক্রি শেষ, আর অন্য মিষ্টি আছে অল্প পরিমাণে। আরেকটি মিষ্টির দোকান ঘুরে দেখলাম একই অবস্থা।
ঈদের সময়ে গ্রামীণ অঞ্চলের মিষ্টি, বেকারি আইটেম এবং অন্যান্য উপহার সামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায় ব্যাপকভাবে। এতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা হয় লাভবান। ঈদে সাধারণত গ্রামীণ এলাকার কৃষকও তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য যেমনÑ সবজি, ফল, মধু ইত্যাদি বিক্রি করে বেশি আয় করার সুযোগ পান।
ঈদুল ফিতরে পর্যটন খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থনৈতিক লেনদেন হয়েছে। যেহেতু এবার সরকারি চাকরিজীবীরা দীর্ঘ নয় দিনের ছুটি পেয়েছেন, তাই এই সময়ে দেশের বিভিন্ন পর্যটনস্থল ভ্রমণে যান তারা। বিশেষত কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, শ্রীমঙ্গল, কুয়াকাটা, নীলগিরি ইত্যাদি স্থানগুলোতে ব্যাপক পর্যটক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়াও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর প্রতিও আগ্রহ ছিল লক্ষণীয়। পর্যটন খাতে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ এ সময়ে প্রায় হাজার কোটি টাকার মতো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে পর্যটন খাতে বিশেষ তদারকি ও পর্যটকদের সুরক্ষার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে নানা ব্যবস্থা। অধিক নিরাপত্তা থাকায় বেড়েছে ভ্রমণকারীর সংখ্যাও। তথ্যানুযায়ী, ঈদের ছুটির ৫ দিনে কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে এসেছেন অন্তত ৮ লাখ পর্যটক। কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা, কলাতলী ও লাবণী পয়েন্টের ৫ কিলোমিটারে পর্যটকদের ভিড় ছিল মাত্রাতিরিক্ত। শহরের ৫ শতাধিক হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও কটেজের কোনো কক্ষই খালি ছিল না।
হোটেলগুলোর দৈনিক ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ ৮৭ হাজার। স্থান সংকুলান না হওয়ায় দুজন থাকার একটি কক্ষে গাদাগাদি করে ছয়-সাতজনও থেকেছেন। বহু পর্যটক বেছে নিয়েছেন দূরের নিরিবিলি ও নির্জন এলাকা। বর্তমানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের আশপাশেও গড়ে উঠেছে নান্দনিক পর্যটন স্পট। এসব জায়গা সারাবছর পর্যটকবিহীন থাকলেও ঈদের সময়ে ফিরে আসে প্রাণচাঞ্চল্য।
এ বছর ঈদুল ফিতরের সময় আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ দেশের মধ্যে প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকার কাছাকাছি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু শপিং এবং খাদ্য খাতে ৩,০০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। এছাড়াও ব্যাংক এবং ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঈদুল ফিতর শুধু ধর্মীয় উৎসবই নয়, এটি দেশের অর্থনীতি বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য একটি বড় উৎস হিসেবে কাজ করে। ঈদের সময় কৃষি, ব্যবসা, পর্যটন ও অন্যান্য ছোট-মাঝারি শিল্পগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। ফলে, সাধারণ মানুষের আয় বাড়ে এবং দেশীয় অর্থনীতি হয় চাঙ্গা। দেশজুড়ে আর্থিক লেনদেনের উৎসবমুখর এ সময় দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মূলত, ঈদের পরে অর্থনীতি আবার নতুন করে প্রবহমান হওয়ার গতি ফিরে পায়।
লেখক : সাংবাদিক