
সিডনির মেলব্যাগ
খুব একটা যাওয়া হয় না কোথাও। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো, যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া... আজকাল ক্লান্তি আর অবসাদের মতো এমন কিছু ভিড় করে। আশাবাদী মানুষ আমি। জীবনের চড়াই-উতরাই পার হতে হতে শিখেছি জীবন মানেই আশাবাদ। সে আশাবাদের মূল আসলে কি? জীবনানন্দই এর উত্তর জানতেন। জানতেন বলেই লিখেছিলেন, অর্থ নয় কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় আরও এক অন্তর্গত বিপন্ন বিস্ময় আমাদের রক্তের ভিতর খেলা করে...
এই অন্তর্গত বিস্ময় তাড়িত মানুষ অনেক কিছু করে। করে নতুন কিছু। তারা তা বুঝতে পারে না বলেই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো চমকে দেয়। এক শনিবারের সকালে রোকেয়া আহমেদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে গিয়েছিলাম গলফ ক্লাবের কমিউনিটি হলে। অনেক দূরের পথ। ম্যাকুয়ারি লিংকস নামের জায়গাটি নয়নাভিরাম। এগুলোর বাংলা নাম থাকলে আরও সুবিধা হতো। সে যাই হোক, গলফ মাঠের খোলা সবুজ ওপরে ঝকঝকে নীলাকাশ আর হলের ভেতর টগবগে প্রাণ এক ঝাঁক রমণীকুল।
গোড়াতে কিছুটা শংকিত ছিলাম যে, কি হতে যাচ্ছে। পরে সে শংকা কেটে গেল তাদের পরিবেশনায়। রোকেয়া আহমেদ বিনয়ী। তার নাম শুনেই আমার পায়রাবন্দের বেগম রোকেয়ার কথা মনে পড়েছিল কেন জানি। এটা তো মানতেই হবে বাংলায় যা কিছু মহান চির কল্যাণকর তার বেশিরভাগ করেছেন রোকেয়া, প্রীতিলতা, জাহানারাদের দল। এই অনুষ্ঠানের পুরোধা এবং সমন্বিত শক্তি ছিলেন নারীরা।
নাসরিন মোফাজ্জলের সঞ্চালনায় একঝাঁক নারীর পরিবেশনায় একজন খোকা মূর্ত হয়ে উঠেছিলেন। ভ্রম হচ্ছিল এ বোধ হয় শেখ মুজিবের কথা শুনছি। কিন্তু খোকাটি মূলত একজন মুক্তিযোদ্ধা। সে কারণে এক ঝলকে আমার ভেতর হাওয়ার মতো ঢুকে গেল এই পরিবেশনা। গানে রুমানা ফেরদৌস, রুনু রফিক, রানী নাহিদ, তবলায় সাকিনা আক্তার সকলেই ছিলেন যথাযথ। সঙ্গে আরও যারা ছিলেন তারা না থাকলে সুর আর বাণী পূর্ণতা পেত না কোনোটাই।
অন্তর্গতভাবে তাদের আয়োজন ছিল ক্লাসিক। এই ধ্রুপদী বিষয়টা এখন প্রায় উধাও হবার পথে। সেদিন তাদের পরিবেশনা গীতি আলেখ্যটির নাম মা ও মাতৃভূমি। কেন এই নাম তার কারণ কিন্তু বুঝতে পারিনি। এই সরলীকরণ না করে আরও কোনো কাব্যিক নাম হলে মনে হতো, এর দ্যোতনা আরও বাড়ত।
কত ধরনের অনুষ্ঠানই তো হয়। এর চেয়ে ভালো হয়, মন্দও হয়। কিন্তু একটি সংগঠন কেবল লেখকদের ডেকে আসন পেতে তাদের কথা শুনছে এমনটা চোখে পড়েনি। বইমেলায় হয় এমন কিছু। কিন্তু সেটা লেখকের বই প্রকাশের আনন্দ। এখানে নিজের লেখা পাঠ আর কথা বলা। মুক্ত আড্ডার মতো। এই আয়োজনে ড. আবদুর রাজ্জাক, কাজী আলী, আশীষ বাবলু, সিমি কাজী সুলতানা, আবু সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ, আবু সাঈদ তাদের মর্যাদা বজায় রেখেছেন। তাদের কথা শুনেছেন সবাই।
নিজের কথা বলতে পারি না কখনো। তাই আমার আশ্রয় ছিল বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র আর নজরুল। আশ্রয় নিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথেরও। পুলক অনুভব করেছি শ্রোতা দর্শকদের একাগ্র মনোযোগ। এমনটা বিরল।
এরপর আবার আমরা সবাই রাজা নামে সবাইকে যুক্ত করেছিল ওরা। এগুলো অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা। লেখার বিষয় নয়। যেটা বলতে চাই, পড়ুয়ার আসর যে পায়ে পায়ে এক বছর পার করে ফেলেছে এটা জানতাম না। দূর দেশে বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এক সমাজে এমন পাঠের আসরের বর্ষপূর্তি আমাদের আপ্লুত করেছে। লজ্জিত হয়েছি এই ভেবে, নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে না যেন করি অপমান। আনন্দিত হয়েছি তাদের পাঠের সূচি আর লেখকের নাম শুনে।
কে না জানে বই পড়া মানেই জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা। বই এমন একটা বিষয় যার গন্ধেই মানুষ জ্ঞানী হতে পারে। পৃথিবীর সব আলো, জ্ঞান আর ভালোবাসার আশ্রয় আছে পুস্তকে। যারা এই ডিজিটাল দানবের যুগে ছাপানো বই পড়েন, পাঠ করেন, একটি পাতা হলেও উল্টে দেখেন, তারা আলোর পথযাত্রী। তাদের চেয়ে আলো আর কোনো কিছুই দিতে পারে না। অনুষ্ঠানটিতে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন আমাদের প্রিয় অভিভাবকতুল্য বাঙালি গামা আবদুল কাদির।
সবার সঙ্গে পড়ুয়ার আসরের যোগ আরও নিবিড় হোক। অন্দর মহলে বাইরের জগতে সে আলো ঠিকরে পড়ুক। যেমনটা কবিগুরু লিখেছেন- গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে... বইয়ের আসর পড়ুয়ার আসর। তাদের যোগে জয়ী হোক আমাদের প্রবাসী ভুবনও।dasguptaajoy@hotmail.com