
বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতম
বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অন্যতম। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় সড়কে ঝরছে প্রাণ। ঘন ঘন দুর্ঘটনায় মহাসড়ক যেন মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঘটছে নানা মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। গণমাধ্যমে প্রতিদিনই ভেসে উঠছে সড়ক দুর্ঘটনার বীভৎস ও করুন চিত্র। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে আসছে সড়ক দুর্ঘটনার রক্তমাখা স্থির চিত্র।
নিহত ও আহতদের স্বজনের আহাজারিতে ভারি হচ্ছে পরিবেশ। অপ্রত্যাশিতভাবে অনেক যুবক ভুল করার বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে, যা আমাদের সড়কের অস্থিরতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। কর্মক্ষম ব্যক্তি বা প্রিয় মানুষদের হারিয়ে স্বজনরা নির্বাক। দ্রুত গন্তব্য পৌঁছানোর তাড়াহুড়া কিংবা একটু অসতর্কতায় নিমিষেই সব আয়োজন শেষ হচ্ছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, ২০২৪ সালে দেশে ৬ হাজার ৯২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২৯৪ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১২ হাজার ১৯ জন, যা গত বছরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। প্রতিনিয়ত সড়কে ঝরছে প্রাণ। সড়ক দুর্ঘটনা একদিকে যেমন শোকের বিষণœ ছায়া ফেলে তেমনি অপরদিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতেও বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দেশে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সাধারণত মহাসড়কে বিপজ্জনক ওভারটেকিং, বেপরোয়া গতি এবং চালক ও পথচারীদের অসতর্কতা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তা ছাড়া মহাসড়কে গাড়িগুলোর গতির ঝড় এবং ছোট গাড়িগুলো মহাসড়কে এলোপাতাড়ি চলাচল সড়ক দুর্ঘটনার প্রবণতাকে প্রবল করে তুলে। গাড়ি চালানোর সময় চালকের অন্যমনস্কতা, মোবাইলে বা পাশে কারো সঙ্গে কথা বলা কিংবা খাবার খাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
টানা গাড়ি চালানোর ফলে অনেক চালক তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যান বা শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ড্রাইভিং করলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সহায়ক। যেমনÑ প্রবল কুয়াশার কারণে দৃষ্টি শক্তি সংকুচিত হয়ে আসে। ফলে সামনের বস্তু সঠিকভবে দেখা যায় না। এজন্য দেখা যায় অনেক গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায় বা সরাসরি মুখোমুখি সংঘর্ষ সংঘটিত হওয়ার সম্মুখীন হয়।
পথচারীদের অসতর্কতা ও অসচেতনতা, ভাঙা বা ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও মদ্যপান করে গাড়ি চালানোয় অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়াও ট্রাফিক সিগন্যাল ও ট্রাফিক আইন না মানা, চালকদের প্রশিক্ষণ না থাকা, দীর্ঘ যানজটের কারণে গাড়ি চালকদের অধৈর্য হওয়া এবং তাড়াহুড়ো করে গাড়ি চালানোর ফলে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে।
ক্ষেত্র বিশেষে অনেক পথচারীর সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন না থাকার ফলে এলোপাতাড়ি রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় বিপত্তি ঘটে। মানসিক উদ্বেগ বা চাপের কারণেও অনেক সময় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে।
দেশে প্রতিদিনই কোনো না কোনো জায়গায় সড়কে ঝরছে প্রাণ। মুহূর্তেই তাজা রক্তে রাস্তার কালো পিচ লাল হয়ে যাচ্ছে। বলা হয় একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না। সড়ক দুর্ঘটনার ফলে অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেন। আবার অনেকের জীবনপ্রদীপ নিভে যাচ্ছে অকালেই। সড়কপথের দুর্ঘটনার মহামারি রোধে আমাদের সচেতনতার বড্ড অভাব পরিলক্ষিত হয়। অথচ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
সেই সঙ্গে চালকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নিতে হবে এবং সতর্কতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগও আবশ্যক। রাস্তা পারাপারে পথচারীদের অবশ্যই জেব্রা ক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করতে হবে এবং পথচারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। চালকরা যেহেতু যথেষ্ট মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রম করেন তাই নিয়মিত চালকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় বেপরোয়া গতির প্রতিযোগিতা পরিহার করতে হবে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও জনসমাগম স্থানে গাড়ির গতি কম রাখতে হবে। গাড়ি চালানোর সময় চালককে অবশ্যই মনঃসংযোগ ধরে রাখতে হবে এবং সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালাতে হবে। একটানা দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো উচিত নয়। রাত্রে গাড়ি চালানোর জন্য পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্লান্তি ও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় গাড়ি চালানো পরিহার করতে হবে।
মোটরসাইকেল চালানোর সময় অবশ্যই হেলমেট পরিধান করতে হবে। মদ্যপান অবস্থায় গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। রাতে গাড়ি চালানোর সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। নির্মাণ ত্রুটিজনিত কারণে সড়কে যে বিপজ্জনক মোড় বা বাক রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে সংস্কার করা প্রয়োজন। সড়ক ও মহাসড়কে ডিজিটাল নজরদারির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। দুর্ঘটনা রোধে সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি যানবাহনচালক, পথচারী, মালিক, যাত্রী ও শ্রমিক সবাইকে আন্তরিক ও সচেতন হতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে এবং নিরাপদ সড়কের জন্য সড়কে বিদ্যমান নৈরাজ্যও বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, জীবনের চেয়ে সময়ের মূল বেশি হতে পারে না। সড়ক দুুর্ঘটনা কখনোই কাম্য নয়।