
ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন
থাইল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রাজধানী ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠেয় ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন গত বছর ২২ আগস্ট স্থগিত করা হয়। সাত জাতির আঞ্চলিক জোটের শীর্ষ সম্মেলন স্থগিতের সাত মাসের মাথায় সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় গত ৩ ও ৪ এপ্রিল। বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক)- বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরশীল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৭টি দেশ নিয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক জোট।
ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, ৬ জুন ১৯৯৭ সালে বিমসটেক প্রতিষ্ঠিত হয় আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য। ১৯৯৮ সালের ১৯ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, পরিবহন ও যোগাযোগ, জ্বালানি শক্তি, পর্যটন, প্রযুক্তি, মৎস্যসহ ৬টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
২০০৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ৮ম মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় কৃষি, জনস্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ দমন, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা যুক্ত করা হয়। সর্বশেষ, ২০০৮ সালে নয়াদিল্লিতে ১১তম মন্ত্রিসভায় জলবায়ু পরিবর্তন খাত সংযুক্ত করে মোট ১৪টি ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হয়।
বিমসটেকের সাতটি সদস্য রাষ্ট্রের (বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভারত ও শ্রীলঙ্কা) মোট আয়তন ৪৮,৭৬,৯৪১ কিমি। জনসংখ্যা ১,৭২৩,৩৮৮,৬৪৮ কোটির বেশি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক জোট বিমসটেক। এ অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে এই জোট।
সদস্য দেশগুলোকে প্রতিটি খাতের জন্য ‘লিড দেশ’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। বিমসটেকের সনদ অনুসারে, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চেয়ারম্যানের পদ বর্ণানুক্রমিকভাবে আবর্তিত হয়। এ বছর বিমসটেক সম্মেলন সাতটি প্রধান আঞ্চলিক সহযোগিতা স্তম্ভের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এগুলো হলো ১. বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন ২. পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন ৩. নিরাপত্তা ৪. কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা ৫. জনগণের মধ্যে সংযোগ ৬. বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন এবং ৭. কানেকটিভিটি।
আঞ্চলিক উন্নয়নে এ জোটের উদ্দেশ্য হলো- শিক্ষা, বৃত্তিমূলক ও প্রাযুক্তিক প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সুবিধা প্রদানে পারস্পরিক সহযোগিতা। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সম্মিলিত স্বার্থে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান।
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি আঞ্চলিক জোটই স্থানীয় উন্নয়নে কোনো না কোনো ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু উপমহাদেশে যত আঞ্চলিক জোট রয়েছে, সার্ক, আসিয়ানসহ কোনোটিই তেমন কার্যকর নয়। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী মনস্তত্ত্বের কারণে ও বিগব্রাদার সুলভ আচরণের ফলে আঞ্চলিক জোটগুলো খুব একটা কার্যকর হয় না।
তবে গত বছর ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে স্বেচ্ছাচারী শাসনের অবসানউত্তর ভারত-বাংলাদেশ তিক্ত সম্পর্কের প্রেক্ষিতে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকগণ। এবারের বিমসটেক সম্মেলনে বেশ ক’টি সাইড বৈঠকের মধ্যে অন্যতম অর্জন হলো, মিয়ানমার সামরিক জান্তা কর্তৃক ১ লাখ ৮০ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ফিরিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতি প্রদান।
বর্তমানে নিবন্ধিত সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাস করছে। শুধু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসের মধ্যেই ৮ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে। কিন্তু প্রায় আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারের জান্তা সরকার ফেরত নেয়নি। মিয়ানমারের জান্তা সরকার জানিয়েছে, কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া তালিকাভুক্ত ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার যোগ্য। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ৪ এপ্রিল শুক্রবার সকালে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্কককে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে দেশটির বিশিষ্টজনদের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে বিমসটেক কাঠামোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক অংশীদারিত্ব জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা হয়।
অধ্যাপক ইউনূস আসিয়ানে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়ে ঢাকার প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন দানের জন্য থাইল্যান্ডের বিশিষ্টজনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আসিয়ানের খাতভিত্তিক সংলাপে অংশীদার হিসেবে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের। তবে, আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এই গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক গোষ্ঠীর পূর্ণ সদস্য হওয়া।’
সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে স্বাগতিক দেশ থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আগামী দুই বছরের জন্য বঙ্গোপসাগরীয় দেশগুলোর আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। ৪ এপ্রিল মধ্যাহ্নে ব্যাঙ্ককের সাংরিলা হোটেলে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকারের পতনোত্তর ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর এটাই হলো বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে প্রথম কূটনৈতিক বৈঠক। ইউনূস-মোদির এ বৈঠকে হাসিনার প্রত্যর্পণ, পানিবণ্টন ও সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়ে আলোচনা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি বৈঠকে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব অস্বস্তি দূর হয়ে যাবে, এমনটি নয়। কিন্তু দু’পক্ষের সম্পর্কের সুন্দর ভবিষ্যত বিনির্মাণে আলোচনার পথ সুগম করবে। ভারত সমর্থিত আওয়ামী লীগ সরকারের পটপরিবর্তনের পর থেকে ভারতের সঙ্গে অস্বস্তিকর সম্পর্ক বিরাজ করছে।
অপরদিকে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা গণমাধ্যমে বেফাঁস কথা বলছেন, সে বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ। ভারত থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে অপপ্রচার চালানো হয়, সে বিষয়েও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের পরে ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাস্তবভিত্তিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক চায় ভারত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের জনগণকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বলা হয়, দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা উভয় দেশের জনগণের জন্য যথাযথ সুবিধা বয়ে আনবে।
বিমসটেক সম্মেলনে, ড. ইউনূস তার বক্তব্যে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি ও অগ্রাধিকার উপস্থাপন করেন। তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর বিমসটেক গঠন, আঞ্চলিক যোগাযোগ সম্পর্কিত বিমসটেক মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ড. ইউনূস মুক্ত বাজার বা এফটিএ সংক্রান্ত বিমসটেক ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি বাস্তবায়নের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন এবং আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস ব্যাঙ্ককে তার সংক্ষিপ্ত সফরের সময় সম্মেলনের পাশাপাশি বিমসটেক ইয়ং জেনারেশন ফোরামেও বক্তব্য রাখেন। বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে তিনি সদস্য দেশের পারস্পরিক স্বার্থ এবং ভাগাভাগি করে লাভবান হওয়ার জন্য একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।
সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নেতারা সর্বসম্মতিক্রমে ব্যাঙ্কক ঘোষণাপত্র এবং বিমসটেক ব্যাঙ্কক ভিশন গ্রহণ করেন, যা একটি কৌশলগত রোডম্যাপ এবং এই জোটকে টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিকভাবে একীভূতকরণের দিকে ধাবিত করা।
বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার কাছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে বাংলাদেশী পর্যটকদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ঢাকার থাই দূতাবাসের বেশি ভিসা প্রক্রিয়ার সক্ষমতা নেই। বিশেষ করে বাংলাদেশী যারা থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নিতে আসেন, তারা ভিসা জটিলতার সম্মুখীন হন।
ঢাকার থাই দূতাবাসে পর্যটক ও চিকিৎসা সেবা প্রার্থীদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়। ভিসা প্রার্থী বাংলাদেশীদের লম্বা লাইনের ভোগান্তি থেকে বাঁচাতে থাই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী সিনাওয়াত্রা প্রধান উপদেষ্টাকে আশ্বস্ত করে বলেন, বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। প্রফেসর ইউনূস বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইট চালু করা হলে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড ভ্রমণের সময়ও কমিয়ে আনা যেতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা দুদেশের মধ্যে বাণিজ্য, জাহাজ চলাচল ও সমুদ্রসীমা সম্পর্ক এবং বিমান যোগাযোগ সম্প্রসারণের আহ্বান জানান। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে থাইল্যান্ড, ভারত ও মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করে ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক প্রকল্পে অংশ নিতে চায় বাংলাদেশ। তিনি থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা ভূমিবলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, যিনি ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
প্রফেসর ইউনূস বিমসটেকের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করায় থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের নেতা ড. ইউনূস এই আঞ্চলিক জোটে নতুন গতিশীলতা সঞ্চার করবেন।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে। আমরা সার্ক ও বিমসটেকের গর্বিত সদস্য। তিনি বলেন, ‘এই পথেই আমাদের ভবিষ্যৎ।’
লেখক : সাংবাদিক