
সম্পাদকীয়
বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জাহাজ ভাঙা শিল্প যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে এই শিল্প উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমুদ্র সৈকতগুলোতে গড়ে উঠেছে বড় বড় পুরানো জাহাজের রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি। এর কারণ- অল্প পারিশ্রমিক, সস্তায় কাঁচামালের জোগান ও চাহিদা ইত্যাদি।
তবে সম্প্রতি এলসি খুলতে ব্যাংকের কঠিন শর্ত, স্ক্র্যাপ জাহাজের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবেশ-মানবাধিকার সংগঠনের নামে শ্রমিকদের উস্কানি, বিদেশী স্ক্র্যাপ জাহাজ বিক্রিতে অনীহা প্রকাশসহ দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রে চট্টগ্রামের সীতাকু- সমুদ্র উপকূলে গড়ে ওঠা দেশের প্রধান জাহাজ ভাঙা শিল্পের ইয়ার্ডগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। ইতোমধ্যে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ শিপইয়ার্ড ব্যবসায়ী ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। আবার অনেকে চলে গেছেন আত্মগোপনে, অনেক ছোট ব্যবসায়ী ঝরে পড়েছেন এ ব্যবসা থেকে।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই শিল্পকে ধ্বংস করতে গত কয়েক বছর ধরে একটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। চক্রান্তের কারণে গত বছর জাহাজ ভাঙা ব্যবসার কার্যক্রম কয়েক মাস বন্ধ ছিল। এ ঘটনার পর বিভিন্ন ধরনের কঠিন শর্ত পূরণ করে যখন শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে জাহাজ ভাঙা শুরু হয়, তখন চক্রটি অন্য একটি ইস্যু নিয়ে আবারও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
অথচ এ শিল্প আগের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব। হংকং কনভেনশনের আলোকে শিপইয়ার্ডগুলো ক্রমান্বয়ে গ্রিন শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। সাতটি শিপইয়ার্ড ইতোমধ্যে গ্রিনইয়ার্ড হিসেবে সনদ লাভ করেছে। তারপরও এ শিল্পকে নিয়ে নানা অপবাদ ও মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানো হচ্ছে। যে কারণে পুরানো জাহাজ আমদানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
সীতাকু-ের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ২০ কিলোমিটার উপকূলে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের সংখ্যা ১৮০টি হলেও বর্তমানে সচল রয়েছে মাত্র ২২টি। সব ইয়ার্ড চালু থাকলে প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পেত সরকার। জাহাজ ভাঙা শিল্পে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেই জীবন চালাচ্ছেন অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক। বর্তমানে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের ৫০ শতাংশ জোগানদাতা শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো। ইস্পাত কারখানাগুলো
প্রধানত জাহাজ ভাঙার লৌহজাত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। এমন পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাময় ইস্পাত খাত পড়েছে সংকটে। দামও বাড়ছে ক্রমাগত। পাশাপাশি কাঁচা লোহার খনিখ্যাত এই শিল্প বন্ধ হলে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে সরকার। সেই সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত দুই লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়বেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থায় সরকারিভাবে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সুবিধা দিলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবেন। পাশাপাশি এই শিল্পের বিকাশ ঘটার সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে।