ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১

সংস্কারের মুখোমুখি বিএনপি নয়, বিএনপিই সংস্কারের পথপ্রদর্শক

মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

প্রকাশিত: ২০:১০, ৭ এপ্রিল ২০২৫

সংস্কারের মুখোমুখি বিএনপি নয়, বিএনপিই সংস্কারের পথপ্রদর্শক

ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এক নতুন মোড় নিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়ার পর নতুন করে রাষ্ট্র নির্মাণের প্রশ্নে এখন নানামুখী আলোচনা, প্রস্তাবনা ও মতপার্থক্য আমাদের জাতীয় জীবনের কেন্দ্রে উঠে এসেছে। তবে দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, এই গুরুতর বিষয়ে সবচেয়ে পুরনো ও ধারাবাহিক অবস্থান রাখা রাজনৈতিক দল বিএনপিকেই যেন উদ্দেশ্যমূলকভাবে সংস্কারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। কেউ বলছে বিএনপি সংস্কার চায় না, কেউ বলছে বিএনপিই সংস্কারে বাধা। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপিই এই দেশে প্রথম ‘সংস্কার’ শব্দটিকে রাষ্ট্রনীতির ভাষায় উচ্চারণ করেছে।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যখন ২৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তখন অনেকেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নিতে পারেননি। কিন্তু আজ দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার কেন্দ্রে যে বিষয়গুলো—উচ্চকক্ষ, বিচার সংস্কার, দুদক ও জনপ্রশাসন সংস্কার, সংবিধান সংশোধন বা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা হ্রাস—এইসবই প্রথম আলোচিত হয়েছে বিএনপির 'ভিশন ২০৩০' ও পরবর্তীতে '৩১ দফা সংস্কার রূপরেখা'তে। এমনকি রাজনৈতিক পরিসরে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার ধারণাও প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরে বিএনপি।

এখন যখন জাতীয় ঐক্যের নামে সংস্কারের নানা প্যাকেজ আসছে, তখন প্রশ্ন তুলতে হয়—কেন বিএনপির দীর্ঘদিনের কাজ ও প্রস্তাবনাকে পাশ কাটিয়ে দলটিকেই সংস্কারের বিরুদ্ধে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে? আসলে মূল ভয়ের জায়গা হচ্ছে—একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বিএনপির বিজয় এখন অনেকের কাছেই আশঙ্কার কারণ। ফলে কেউ কেউ চেষ্টা করছে, যে কোনোভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করে, বিএনপির বিজয়ের পথ রুদ্ধ করা যায় কিনা।

বিএনপি বরাবরই বলছে, ‘সংস্কার ও নির্বাচন’ একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়—বরং দুইটিই একে অপরকে পরিপূরক। নির্বাচনের মাধ্যমেই সংস্কারের বৈধতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচি হলো সেই রোডম্যাপ, যার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের স্বপ্ন দেখছে দলটি। এই প্রস্তাবনাগুলো রাতারাতি তৈরি হয়নি, বরং এর শিকড় ২০১৭ সালে খালেদা জিয়ার ঘোষিত ‘ভিশন ২০৩০’ পর্যন্ত বিস্তৃত।

বিএনপির অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট—দলটি লোক দেখানো সংস্কার বা চটকদার প্রতিশ্রুতির পক্ষে নয়, বরং এমন সংস্কার চায় যা বাস্তবায়নযোগ্য, সময়োপযোগী ও দেশীয় বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—বিচার বিভাগ নিয়ে প্রস্তাবিত ২৩টি সুপারিশের মধ্যে ২০টি, দুর্নীতি দমন কমিশনের ২০টির মধ্যে ১৯টি, এবং জনপ্রশাসনের ২৬টির মধ্যে প্রায় অর্ধেক প্রস্তাবে বিএনপি ইতিবাচক মত দিয়েছে। একই সাথে যে-সব সুপারিশ অবাস্তব বা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে, সেখানে দলটি ভিন্নমত জানিয়েছে—এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

উচ্চকক্ষের প্রসঙ্গে বিএনপির প্রস্তাব নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, কেন বিএনপি নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে? এখানেই আসে বিএনপির গণতান্ত্রিক গভীরতা। দলটি মনে করে, যেহেতু উচ্চকক্ষ হবে পেশাজীবী, বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার ও সংস্কৃতি জগতের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে, তাই সেই গঠনে জনভিত্তিক প্রভাব থাকাও জরুরি। পরাজিত প্রার্থীদের পুনর্বাসনের জায়গা নয় এটি, বরং জনমতের উপর দাঁড়িয়ে জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

অন্যদিকে, একক নির্বাহী ক্ষমতা হ্রাস প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান খুবই সুস্পষ্ট। বর্তমান ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন কার্যত সংসদীয় ব্যবস্থাকে একনায়কতন্ত্রে পরিণত করছে। বিএনপি তাই ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার, অল-পার্টি সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিয়োগ, এবং নিরপেক্ষ সংস্কার কমিশন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছে। ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিএনপিই প্রথম সাহস করে খোলাখুলি কথা বলেছে—যা বাকিরা কেবল পাশ কাটিয়ে গেছে। আবার ফ্লোর ক্রসিং ইস্যুতে বিএনপি এমন এক ভারসাম্যমূলক পদ্ধতির কথা বলছে যেখানে দলীয় শৃঙ্খলা ও মত প্রকাশ—দুইটি একসাথে টিকে থাকবে।

ন্যাশনাল কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল (এনসিসি) নিয়েও বিএনপি দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিরোধীদের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা যদি জনমতের বিরুদ্ধে চলে যায়, তবে তা গণতন্ত্রেরই পরিপন্থি হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিএনপি চাইছে—জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন হোক। এই ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল নীতির সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এখানে আরেকটি দিকও স্পষ্ট করা দরকার—দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার প্রস্তাবও বিএনপিই প্রথম এনেছে। অথচ এখন সেই বিএনপিকেই মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, বিএনপির গ্রহণযোগ্য সংস্কার দর্শনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে রাখার মাধ্যমে এক বিকল্প রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা।

এই অবস্থায় প্রশ্ন জাগে—সংস্কার কি নির্বাচন ঠেকানোর কৌশল হবে, নাকি তা হবে নির্বাচন-উত্তর রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রূপরেখা? বিএনপি বিশ্বাস করে—একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের রায় প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং সেই রায়ের ভিত্তিতেই টেকসই সংস্কার সম্ভব হবে। আর সেজন্যই সবচেয়ে জরুরি সংস্কার—ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। কারণ, কেবল ভোটের অধিকার নিশ্চিত হলেই একটি সরকার জনমুখী হতে বাধ্য হয়। তখনই সরকার জানবে, পাঁচ বছর পর তার জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সেটিই গণতন্ত্রের আসল শক্তি।

বিএনপি গত ১৬ বছর ধরে ভোটের অধিকার ফেরানোর জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে, হাজারো নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছে, গুম-খুন-জেল সহ্য করেছেন। এই সংগ্রামের ফসলই হবে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনের মাধ্যমেই শুরু হবে একটি টেকসই ও কার্যকর রাষ্ট্র সংস্কারের নতুন যাত্রা।

রাকিব

×