ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্র বনাম বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা

নবাব শাহজাদা

প্রকাশিত: ১৮:২৫, ৭ এপ্রিল ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্র বনাম বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা

প্রতীকী ছবি

শিক্ষা একটি জাতির উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা একে অপরের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। এই পার্থক্য শুধু শিক্ষার কাঠামোতেই নয়, বরং শিক্ষাদানের পদ্ধতি, মূল্যায়ন, সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত নমনীয় এবং সেখানে শিক্ষার্থীদের পছন্দ ও স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে একটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কেজি বা কিন্ডারগার্টেন থেকে এবং এটি উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মোট বারো বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে গভীরভাবে জানার সুযোগ দেওয়া হয় এবং তারা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিষয় বেছে নিতে পারে।

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েই শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে এবং তাদের কাছে নানা বিকল্প থাকে, যেমন- টেকনিক্যাল ট্রেনিং, অ্যাডভান্সড প্লেসমেন্ট কোর্স কিংবা কমিউনিটি কলেজের কোর্স নেওয়ার সুযোগ। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও ব্যবহারিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনার উন্নতি ঘটায়।

অন্যদিকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই কাঠামোগত এবং নিয়ন্ত্রিত। শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম নির্ধারিত থাকে। এখানে বিষয় নির্বাচন করার স্বাধীনতা তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তিনটি প্রধান স্তরে বিভক্ত- প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং সরকারি উদ্যোগে এটি বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে যেকোনো একটি বেছে নিতে হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ারকে অনেকাংশে নির্ধারণ করে দেয়। এক্ষেত্রে অনেক শিক্ষার্থীকে বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট শাখা বেছে নিতে হয়, যা তাদের প্রকৃত আগ্রহ বা দক্ষতার সঙ্গে সবসময় মানানসই হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষা ও গ্রেডের চাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। কারণ তাদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় প্রকল্প, ক্লাস পারফরম্যান্স, গবেষণা এবং অন্যান্য কার্যক্রম যুক্ত থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়নের ওপর নির্ভরশীল। ফলে শিক্ষার্থীরা মুখস্থবিদ্যার প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে এবং সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ কম পায়। পরীক্ষানির্ভর এই শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক শিক্ষার্থী মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে, যা তাদের শিখন-প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।

সহশিক্ষা কার্যক্রমের দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে। তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাধুলা, সংগীত, শিল্প, বিতর্ক এবং অন্যান্য ক্লাব কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পরিচালিত হয়, যা শিক্ষার্থীদের বহুমুখী দক্ষতা উন্নয়নে সহায়তা করে।

অপরদিকে বাংলাদেশে সহশিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র পাঠ্যবইয়ের পড়াশোনার ওপর গুরুত্ব দিতে হয়। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিতর্ক, রোবটিক্স, স্কাউটিং ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, তবুও এটি এখনো শিক্ষার মূলধারায় সম্পূর্ণভাবে একীভূত হয়নি।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও দুটি দেশের মধ্যে বড় পার্থক্য বিদ্যমান। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয় এবং শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। সেখানে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে গবেষণা করার ও নতুন কিছু আবিষ্কার করার সুযোগ থাকে। অপরদিকে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার সুযোগ সীমিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষার পদ্ধতি পাঠ্যবইকেন্দ্রিক থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের বিশ্লেষণধর্মী ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনার সুযোগ কমে যায়।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়বহুল। তবে তাদের কাছে স্টুডেন্ট লোন, স্কলারশিপ এবং পার্ট-টাইম চাকরির সুযোগ থাকায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে পারে। বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার ব্যয় তুলনামূলকভাবে কম। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যয় অনেক বেশি, যা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য উচ্চশিক্ষা অর্জনকে কঠিন করে তোলে।

উভয় দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও দুটি ব্যবস্থারই কিছু ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা ও গবেষণার সুযোগ দিলেও এটি ব্যয়বহুল এবং প্রতিযোগিতামূলক। অপরদিকে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী এবং কিছু ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রিত, যা শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ সরকার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক ও দক্ষ করার চেষ্টা করছে, যা ভবিষ্যতে আরও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ

নবাব শাহজাদা/রাকিব

×