ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১

ভবিষ্যৎ হোক নিরাপদ ও সম্ভাবনাময়

মোসা. মিশকাতুল ইসলাম মুমু

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ৬ এপ্রিল ২০২৫

ভবিষ্যৎ হোক নিরাপদ ও সম্ভাবনাময়

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আধুনিক বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর সাফল্য, যা মানুষের চিন্তা, শেখা এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে অনুকরণ করে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। মেশিন লার্নিং ও নিউরাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্নতি করতে সক্ষম। ফলে আমরা স্বচালিত গাড়ি, উন্নত রোগ নির্ণয়, সংগীত ও সাহিত্য রচনা এবং রোবটিক্সে মানবসদৃশ আচরণ দেখতে পাচ্ছি। এআই শুধু প্রযুক্তির অগ্রগতি নয়, এটি আমাদের জীবনকে আরও সহজ, দ্রুত এবং কার্যকর করে তুলছে। তবে এর কিছু অজানা দিকও রয়েছে, যা মানবসভ্যতায় বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলতে এমন একটি স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিকে বোঝায় যা মানুষের বুদ্ধিমত্তা, শেখার ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সমস্যা সমাধানের মতো গুণাবলী কম্পিউটার বা মেশিনের মাধ্যমে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। আজকের বিশ্বে এআই-এর ব্যবহার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রোবট, গবেষণায় চ্যাটবট, ডিজাইন ও ওয়েবসাইট তৈরিতে মিডজার্নি বা লিওনার্দো এআই-এর মতো টুল ব্যবহার হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি আমাদের কাজকে দ্রুত ও সহজ করছে, বদলে দিচ্ছে ভবিষ্যৎ।

এআই-এর প্রধান লক্ষ্য হলো মানুষের চিন্তাশক্তিকে মেশিনে প্রয়োগ করে কাজের দক্ষতা ও গতি বৃদ্ধি করা। এটি দ্রুত ও নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারে, যা বিভিন্ন সেক্টরে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। তবে এর চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এআই স্বয়ংক্রিয় হওয়ার ফলে অনেক মানুষ তাদের চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছে। এছাড়া, প্রযুক্তির অপব্যবহার, যেমন ভুয়া ছবি বা ভিডিও তৈরি করে বিভ্রান্তি ছড়ানো, এটিকে একটি বড় উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত করেছে।
বর্তমানে এআই অসাধারণ উন্নতি করেছে। এটি মানুষের ভাষা বুঝতে, ছবি চিনতে এবং এমনকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ি চালাতে সক্ষম। বিভিন্ন এআই টুল যেমন ঈযধঃএচঞ, গরফলড়ঁৎহবু, গঁৎভ.অও, ১০বিন ইত্যাদির মাধ্যমে কনটেন্ট লেখা, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ভয়েস তৈরি এবং ওয়েবসাইট তৈরির কাজ সহজ হয়ে গেছে। এআই মূলত মেশিন লার্নিং (গখ) প্রযুক্তির মাধ্যমে শেখে ও নিজেকে উন্নত করে। আমরা যে এআই প্রযুক্তি দেখছি তার সূচনা বহুকাল আগেই ঘটেছে।

১৯৫৬ সালে ডার্টমাউথ কলেজের একটি গবেষণায় প্রথম এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে জন ম্যাকার্থি প্রোগ্রামিং ভাষা লিস্ট তৈরি করেন যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রোগ্রামিং ভাষা হয়ে ওঠে। ৬০- এর দশকের দশকের মাঝামাঝিতে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ এটির গবেষণার জন্য প্রচুর পরিমাণে তহবিল গঠন করার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ল্যাবরেটরিস প্রতিষ্ঠিত হয়। ৮০- এর দশকের শুরুতে এআই বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করা শুরু করে।

’৮৫ সাল নাগাদ এর মার্কেট ভ্যালু ১ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। ৯০-এর দশকের শুরুতে এআই মাইনিং, চিকিৎসা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এআই এর ব্যবহার শুরু হয়। ডিপ ব্লু ১১ জুন, ১৯৯৭ তারিখে একজন দাবা চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে পরাজিত করার জন্য প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত দাবা খেলোয়াড় হয়ে ওঠে। ২০১০ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে মেশিন লার্নিং অ্যাপ্লিকেশনগুলো ব্যবহার করা হতো।

২০১২ সালে গুগলের মধ্যে এআই ব্যবহার করার জন্য ২৭০০ এরও বেশি প্রকল্প বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ২০২৩ সালে এসে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ আরো অনেক অনেক বেশি দেখতে পাই। এআই এর অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা হারবার্ট সাইমন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলেন ‘মেশিন বিশ বছরের মধ্যে একজন মানুষ যা করতে পারে তা করতে সক্ষম হবে।’ আর বর্তমানে এই কথাটি পুরোপুরি সত্য না হলেও অদূর ভবিষ্যতে কথাটি যে সত্যে পরিণত হবে সেটি বোঝার জন্য আমাদের কোনো গবেষণা করার দরকার পড়ে না।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মূলত ডেটা বিশ্লেষণ, মেশিন লার্নিং (গখ), এবং অ্যালগরিদমের মাধ্যমে কাজ করে। প্রথমে এটি বিশাল পরিমাণ ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে, তারপর মেশিন লার্নিং (গখ) ও ডিপ লার্নিং (উখ) ব্যবহার করে শেখে। মেশিন লার্নিং পুরনো ডেটার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। আর ডিপ লার্নিং মানুষের মস্তিষ্কের নিউরনের মতো কাজ করে গভীর বিশ্লেষণ করে।

এসবের মাধ্যমে এআই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। যেমন- চ্যাটবট ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর দেয়, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট কণ্ঠ শনাক্ত করে কাজ করে, আর স্বয়ংক্রিয় গাড়ি রাস্তার পরিস্থিতি বুঝে চালিত হয়। ক্রমাগত শেখার মাধ্যমে এআই আরও উন্নত হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতে আমাদের জীবনকে আরও সহজ করবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আমাদের জীবনকে সহজ, কার্যকর ও স্মার্ট করে তুলছে। কিছুদিন আগে এআই জেনারেটেড সংবাদপত্র তৈরি করা হয়েছে। ইতালির সংবাদপত্র ‘ইল ফগলিও’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ এআই-জেনারেটেড সংবাদপত্র প্রকাশ করেছে। এক মাসের পরীক্ষার পর চার পাতার ‘ইল ফগলিও এআই’ এডিশন ব্রডশিটের সঙ্গে পাঠকদের কাছে পৌঁছানো হয়। এছাড়াও এআই বিভিন্ন কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করে, যা সময় ও শ্রম সাশ্রয় করে।

এআই নির্ভুলভাবে বিশাল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারে, যা চিকিৎসা, গবেষণা ও ব্যবসায় বিপ্লব ঘটাচ্ছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার কারণে এটি ফিনান্স, স্বাস্থ্যসেবা ও বিপণনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেমনÑ মাইনিং, মহাকাশ গবেষণা বা গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানে এআই ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যক্তিগতকৃত অভিজ্ঞতা দিতেও এআই অসাধারণ, যেমন—ণড়ঁঞঁনব, ঘবঃভষরী বা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে আমাদের পছন্দ অনুযায়ী কন্টেন্ট ও পণ্য সাজেস্ট করা।

এআই ক্রমাগত উন্নতি করছে এবং ভবিষ্যতে এটি ছাড়া জীবন কল্পনা করা কঠিন হয়ে যাবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছে ও খরচ কমাচ্ছে। ২০২২ সালে এআই-এর মার্কেট সাইজ ৩৮৭ বিলিয়ন ডলার ছিল, যা ২০২৯ সালে ১৩৯৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে, এআই আমাদের ভবিষ্যৎকে আরও উন্নত ও সম্ভাবনাময় করে তুলছে।
তবে প্রতিটি নতুন প্রযুক্তির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারও কিছু জটিল দিক রয়েছে, যা আমাদের সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এআই যত উন্নত হচ্ছে, ততই তা নৈতিকতা, গোপনীয়তা এবং কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব ফেলছে। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির প্রসার যেমন মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করছে তেমনি অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়ছে। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গ্রহণ করা সিদ্ধান্তের ওপর অন্ধভাবে নির্ভর করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

বিশেষ করে স্বাস্থ্য, আইন বা প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে। এআই স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ফলে অনেক মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছে। বিশেষ করে ফ্যাক্টরি, কাস্টমার সার্ভিস ও ডেটা এন্ট্রি ক্ষেত্রে। এছাড়া এটি ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এআই বিশাল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে পারে, যা হ্যাকিং ও নজরদারি বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করছে।

এছাড়া এআই-এর ভুল তথ্য ও ডিপফেক প্রযুক্তি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে, যা রাজনীতি, মিডিয়া ও সামাজিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পক্ষপাতমূলক ডেটা থেকে শেখার ফলে এআই বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্তও নিতে পারে, যা চাকরি, ঋণ অনুমোদন বা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে। সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি, স্বয়ংক্রিয় ফিশিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর ম্যালওয়্যারও এআই-এর বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি।

সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হলো মানুষের এআই-এর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, যা সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তিকে কমিয়ে দিতে পারে। যদি এই প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত ও সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় তবে এটি মানুষের উপকারের বদলে বিপর্যয়ও আনতে পারে। তাই আমাদের প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে আমরা এআই-এর শক্তিকে মানবকল্যাণে কাজে লাগাব।

তবে একে এমনভাবে পরিচালিত করব যাতে এটি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও মানবিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। এআই এর সুফল ভোগ করতে হলে এর নিরাপত্তা, নৈতিক ব্যবহার ও সঠিক নিয়মনীতি প্রণয়ন জরুরি, যাতে এটি মানবতার জন্য আশীর্বাদ হয়, অভিশাপ নয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবন ও প্রযুক্তির জগতে বিপ্লব এনেছে। এটি যেমন কাজের গতি ও দক্ষতা বাড়াচ্ছে তেমনই কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকিও তৈরি করছে। কর্মসংস্থানে প্রভাব, গোপনীয়তা লঙ্ঘন ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের প্রসার রোধে এর নৈতিক ও দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি।

সঠিক দিকনির্দেশনা ও নিয়মনীতি অনুসরণ করলে এআই মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ হবে, নইলে তা বড় সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এআই-এর সুফল কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎকে নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় করা আমাদের সবার দায়িত্ব।[email protected]

×