
মিথেন গ্যাস
গ্রিনহাউস গ্যাসের ৭টি অন্যতম উপাদানের মধ্যে ‘মিথেন গ্যাস’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জলবায়ু সংকট বা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য মিথেন গ্যাস নিঃসরণ অনেকাংশে দায়ী। আমরা জানি, কার্বন ডাই অক্সাইড, ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন নিঃসরণ বায়ুম-লের ওজোন স্তর ক্ষয়ের প্রধান উৎস। আমাদের সেই ধারণা সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা পাল্টে দিয়েছেন।
গবেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ‘মিথেন গ্যাসের ছড়িয়ে পড়ার হার যদি কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা না যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ করার জন্যে বিশ্বে যেসব লড়াই সংগ্রাম চলছে, তাতে খুব একটা ফল পাওয়া যাবে না। কারণ, কার্বন ডাই অক্সাইডের তুলনায় মিথেন গ্যাস বায়ুম-লে তাপমাত্রা এক শতাব্দী কাল সময়ব্যাপী ৩০ গুণ বেশি ধরে রাখতে পারে।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাম্পফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও গবেষক রবার্ট জ্যাকসনের মত, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর জন্যে বর্তমানে যেসব কর্মসূচি চালানো হচ্ছে, তাতে কার্বন ডাই অক্সাইডের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে, কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন অনেকটাই দৃশ্যমান।
বিভিন্নভাবেই তা নজরেও পড়ে। ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের প্রতিবাদে পরিবেশবিদদের অথবা সচেতন মানুষদের আলাপ-আলোচনা অথবা সভা-সেমিনারের সুযোগ থাকে। কিন্তু মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ ব্যাপকভাবে নজরে পড়ে না। তাতে করে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ নিয়ে ততটা মাতামাতিও হয় না। ফলে নীরবে মিথেনের বিষক্রিয়ায় পৃথিবীর উষ্ণায়ন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা যদি এখনই মিথেন গ্যাস নিঃসরণের দিকে নজর না দেই, তাহলে সেই ঝুঁকিটা থেকেই যাবে। কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমন কমানোর মধ্য দিয়ে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, মিথেন গ্যাস ছড়িয়ে পড়ার কারণে সেই অগ্রগতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’
বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিতে এবং জলবায়ু সংকট ত্বরান্বিত করতে মিথেন গ্যাসের প্রভাব খুবই মারাত্মক। তাই মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ দ্রুত কমিয়ে আনতে সচেষ্ট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মূলত মিথেন গ্যাসের প্রধান উৎস জীবাশ্ম জ্বালানি।
প্রাকৃতিক গ্যাস, কলকারখানার বর্জ্য, খনিজ কয়লা পোড়ানো, বর্জ্যরে ভাগাড় থেকে মিথেন গ্যাস অধিক হারে নিঃসরিত হচ্ছে। ধানগাছ, গবাদি পশু ও জলাশয় থেকে মিথেন গ্যাস উৎপন্নের সংবাদও আমরা জানতে পেরেছি। সেই হার কতটুকু ক্ষতিকর তা অবশ্য জানা যায়নি অদ্যাবধি।
গবেষণায় উঠে এসেছে, গ্রিনহাউস গ্যাসের মধ্যে অন্যতম ক্ষতিকর হচ্ছে মিথেন গ্যাস। মূলত নানা রকম জৈব পদার্থ পচে যে গ্যাস উৎপন্ন হয়, সেটিই হচ্ছে মিথেন গ্যাস। এই গ্যাস বিশ্বের প্রতিটি দেশেই কমবেশি উৎপন্ন হচ্ছে। এর জন্য বাংলাদেশ এককভাবে দায়ী নয়। ধান উৎপাদন করছে এমন দেশগুলো থেকেও মিথেন উৎপন্ন হচ্ছে। ধানক্ষেতে সেচ দেওয়ার সময় মাটিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া বিপুল পরিমাণ গ্যাস সৃষ্টি করার ফলে মিথেন গ্যাস নিঃসরিত হচ্ছে।
আবার গবাদি পশুর ঢেকুর থেকেও মিথেন গ্যাস উৎপন্নের সংবাদ আমরা জানতে পেরেছি। আমরা আরও জানতে পেরেছি, গবাদি পশুদের ঢেকুর নির্গতের কারণে মিথেন গ্যাসে পরিবেশ বিষিয়ে উঠছে। তাতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক হচ্ছে। তবে সুখবর হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা গবাদি পশুর মুখে লাগিয়ে দেওয়ার একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। যা দেখতে অনেকটা মাস্কের মতো।
এটি গরু বা অন্যান্য গবাদি পশুর মুখে লাগিয়ে দিলে ঢেকুর তোলার পর নির্গত মিথেন গ্যাসকে বন্দি করে ফেলতে সক্ষম হয়। ফলে যন্ত্রের ভেতরেই তা কার্বন ডাই অক্সাইড ও জলীয় বাস্পে পরিণত হয়। উল্লেখ্য, গবাদি পশু যত মিথেন গ্যাস নিঃসরণ করে এর মধ্যে ৯৫ শতাংশই মুখ ও নাসারন্ধ্র থেকে নির্গত হয়। আবার মানুষের বায়ু ত্যাগের মাধ্যমেও মিথেন উৎপন্ন হয়।
সেক্ষেত্রে অবশ্য মিথেন গ্যাসই নয়, হাইড্রোজেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্যাসও উৎপন্ন হয়। এছাড়াও কলকারখানার বর্জ্য, প্রাকৃতিক গ্যাস লাইনে ফাটল, দূষিত ধোঁয়া, খনিজ দ্রব্যের জ্বালানি মিশ্রিত গ্যাস মিথেনের স্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে। যা ঝড়ো হাওয়ায় সীমানা অতিক্রম করে পাশের দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে।
মিথেন গ্যাস যেভাবেই ছড়িয়ে পড়ুক না কেন, এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে সচেষ্ট হতে হবে আমাদের। কারণ, এটি খুবই মারাত্মক একটি গ্যাস। বায়ুম-লে এর বিচরণের ফলে পরিবেশ ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জানা গেছে, গত ২০ বছরে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে পরিবেশের ৮০ গুণ বেশি ক্ষতি করেছে মিথেন গ্যাস। যার ফলে ওজোন স্তর যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি জলবায়ু সংকটে ভীষণ প্রভাব ফেলছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নও বাড়িয়ে দিচ্ছে মিথেন গ্যাসের প্রভাবে। শুধু তাই-ই নয়, মিথেনের প্রভাবে আর্কটিক অঞ্চলের ‘রেইনডিয়ার’ নামক এক প্রজাতির হরিণের আকৃতি ক্রমশ খর্বাকৃতির হয়ে আসছে। ওজন কমে আসছে এবং অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করছে। নরওয়েজিয়ান আর্কটিক অঞ্চলের স্ভালবার্ড এলাকায় এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রফেসর স্টিভ অ্যালবন। তিনি বলেছেন, শীতকালে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়া। তাতে করে তুষারের ওপর মোটা স্তরের বরফের সৃষ্টি হয়। তখন রেইনডিয়ারের পক্ষে খাবার খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। তিনি আরও বলেছেন, গরম আবহাওয়ার কারণে প্রচুর পরিমাণে রেইনডিয়ার এখন সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এবং নভেম্বরে গর্ভধারণ করে।
গোটা শীতকাল জুড়ে পেটের ভেতরে তার সন্তানকে বহন করতে হয়। ঠিক সেই সময় খাদ্যের পরিমাণও কমে যায়। ফলে তাদের জীবন রক্ষাও কঠিন হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই প্রবণতা আর্কটিক অঞ্চলের আরও কিছু প্রাণীর ক্ষেত্রেও চোখে পড়েছে। মূলত মিথেন গ্যাস নিঃসরণের হার বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের অনেক প্রজাতির প্রাণীই বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
নানা বিষয়ে পর্যালোচনা ও গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা স্পষ্ট বলেছেন, মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ দ্রুত কমিয়ে আনতে হবে। তারা লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন বায়ুম-লের তাপমাত্রা যেন বর্তমানের চেয়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি না পায়, সেদিকে নজর দিতে। নচেৎ হিমবাহের ধস নেমে বিশ্ব অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে নিম্নাঞ্চল জলে প্লাবিত হবে। যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
সুতরাং বর্জ্যরে ভাগাড়, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি আমরা আশাবাদী, বিজ্ঞানীরা দ্রুত উপায় খুঁজে বের করবেন, যাতে কৃষিকাজে এবং গবাদিপশু পালনের ক্ষেত্রে মিথেন গ্যাস নিঃসরণের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায়। কারণ, মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে সর্বপ্রথম তার খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্য বিষয়গুলো সামনে আসবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক, পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট