
বাংলাদেশ মূলত একটি গ্রামভিত্তিক সমাজ
বাংলাদেশ মূলত একটি গ্রামভিত্তিক সমাজ। যদিও শাসন ব্যবস্থা শহরকেন্দ্রিক, তথাপি ‘দেশ’ বলতে এখনো গ্রামকেই বোঝানো হয়। উৎপাদন, উৎসবÑ সবকিছুতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গ্রামই। শহরের বাসিন্দাদের অধিকাংশের শিকড়ও কিন্তু রয়ে গেছে গ্রামেই। তাই নানা উৎসব বা দুর্যোগের সময় মানুষ এখনো গ্রামে ফিরে যেতে পছন্দ করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল।
তেমনি, কোভিড-১৯ মহামারির সময়ও শহরের বহু মানুষ গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। শুধু স্বাস্থ্য সংকটই নয়, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অনেক মানুষ গ্রামে ফিরে গেছে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, উৎসব কিংবা দুর্যোগে বাংলাদেশের মানুষের আসল এবং প্রকৃত ঠিকানা হলো তাদের গ্রাম।
এই কারণেই দুই ঈদ, দুর্গাপূজা বা শীতের ছুটিতে শহরের লাখ লাখ মানুষ গ্রামে ছুটে যায়। শহরে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের কাছে দেশ বলতে তাই এখনো তাদের গ্রামের বাড়িকেই বোঝায়। উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি সাধারণত একটি মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকে। আর অনেক উচ্চবিত্ত গ্রামকে তাদের আসল ঠিকানা মনে করে না। তারা মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে গ্রামের বাড়ি বা জমিজমা দেখতে যায়। সকালে গিয়ে বিকেলের মধ্যে শহরে ফিরে আসে।
বর্তমানেও বাংলাদেশের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ গ্রামে বসবাস করে। তবে অতীতের গ্রাম এবং বর্তমানের গ্রামের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এটি দৃশ্যত এবং অভ্যন্তরীণভাবে অনুভূত হয়। যেহেতু বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ, তাই দুই ঈদে গ্রামীণ পরিবেশ বিশ্লেষণ করলে আমরা গ্রামের পুরনো এবং বর্তমান চিত্রের পাশাপাশি ঈদের পরিবর্তিত রূপ স্পষ্টভাবে দেখতে পাই।
তিন দশক আগে গ্রামে ঈদ ছিল একটি সমষ্টিগত আনন্দের চিত্র। গ্রামের সবাই কোনো না কোনোভাবে ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করত। ঈদের প্রস্তুতি, ঈদের নামাজ, তারপর দুই-তিন দিন ধরে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ করা ছিল ঈদের একটি অপরিহার্য অংশ। কিন্তু এখন সেই আন্তরিক এবং প্রাণবন্ত দৃশ্য আগের মতো আর দেখা যায় না।
আজকাল অনেক সময় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রাও বাড়িতে গিয়ে দেখা করে না। আগে ঈদের সময় খুব সহজেই বোঝা যেত কে কার আত্মীয়। যদিও বছরের অন্য সময়ে দেখা-সাক্ষাৎ হতো না, ঈদের সময় আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হওয়া ছিল এক ধরনের অঘোষিত রীতি। তবে বর্তমানে সেই রীতি অনেকটা মুছে গেছে। নতুন বিবাহিত দম্পতিরা হয়তো প্রথম দুই-তিন বছর এই ঐতিহ্য বজায় রাখে, কিন্তু পরে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়।
এখন ঈদের শুভেচ্ছা এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং ঈদের আন্তরিকতা সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, যা পরিণত হয়েছে একটি রাজনৈতিক শুভেচ্ছায়। এখন স্থানীয় কর্মীরা ঈদের পাঞ্জাবি উপহার পায় এবং ঈদের বিকেলে দলবেঁধে নেতার সঙ্গে দেখা করতে যায়। পাশের বাড়ির আত্মীয়দের খোঁজ না নিলেও, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাটাই যেন হয়ে উঠেছে প্রধান কর্তব্য।
গ্রামে ঈদের অন্যতম আনন্দের মুহূর্ত ছিল স্থানীয় বাজারের দোকানে বসে টিভি দেখা। ঈদের বিকেলে তরুণ থেকে শুরু করে মাঝবয়সীরা দোকানে ভিড় করত বিটিভিতে প্রচারিত বাংলা সিনেমা দেখার জন্য। দোকানিরা আগেই সিনেমার সম্প্রচারের খবর প্রচার করত এবং দর্শকদের কাছ থেকে দুই-তিন টাকা করে ফি নিত। পাশাপাশি দোকানে বেচাকেনাও বাড়ত। তখন ছায়াছবি এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম সবার মুখে মুখে ঘুরত।
তাছাড়াও ঈদের রাতে বিশেষ নাটক, আনন্দ মেলা, ঈদের গান এবং সংগীতানুষ্ঠানও ছিল বিশেষ আকর্ষণ। রুনা লায়লা বা সাবিনা ইয়াসমিনের একক সংগীতানুষ্ঠান, আনন্দমেলা এবং ছায়াছন্দের ঈদের বিশেষ পর্ব ছিল দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়। তখন বিটিভি এখনকার টিভিগুলোর মতো আগেভাগে ঈদের তিন-চার দিনের অনুষ্ঠানসূচি ঘোষণা করত না।
দর্শকরা তা জানতে পারত ইত্তেফাক বা ইনকিলাব পত্রিকায় প্রকাশিত ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানের তালিকা থেকে। অনেকেই সেই অংশ কেটে রেখে দিত, যেন ঈদের দিনে কোনো অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হবে তা ভুলে না যায়।
এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। কেউ আর বাজারের দোকানে আড্ডা দেয় না। এখন প্রায় সবার বাড়িতেই টেলিভিশন রয়েছে এবং সঙ্গে আছে ডিস সংযোগও। অসংখ্য টেলিভিশন চ্যানেলের কারণে মানুষ নিজের পছন্দ অনুযায়ী অনুষ্ঠান দেখতে পারে। তবে আগের মতো একসঙ্গে বসে অনুষ্ঠান দেখার ঐতিহ্য আর নেই। আগে দোকানের টিভির সামনে যেমন সবাই একত্রিত হত, এখন বাড়িতেও সবাই আলাদা আলাদাভাবে দেখে। কারণ বিকল্পের সংখ্যা এখন অনেক বেশি।
এছাড়াও মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহার মানুষকে আরও বিচ্ছিন্ন করেছে। তরুণ ও কম বয়সীরা এখন ইউটিউব বা অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভিডিও দেখে সময় কাটায়। ফলে দেখা যায়, বাড়িতে, বাজারে বা দোকানে একসঙ্গে থাকার পরেও, সবাই যেন নিজের দুনিয়ায় হারিয়ে গেছে। একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা না বলে প্রত্যেকে নিজ নিজ মোবাইলে ডুবে থাকে।
আগে ঈদের সময় গ্রামের বাজারে স্থানীয়দের সঙ্গে যোগ দিত দুই ধরনের মানুষ, যাদের আদি ঠিকানাও ওই গ্রামে। একদল ছিল কম/অশিক্ষিত কর্মজীবী। যারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, কাপ্তাইসহ বিভিন্ন শহরে অফিস, ফ্যাক্টরি বা গার্মেন্টসে কাজ করত। ঈদের ছুটিতে তারা গ্রামে ফিরে এসে বাজারে জমা হতো। আর তাদের পদচারণায় পুরো এলাকা প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। অপরদিকে, বাজারে দেখা মিলত শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ, যাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ছিল কম। যেমনÑ সরকারি-বেসরকারি অফিসের চাকরিজীবী বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।
এখন সেই সমাবেশ অনেকটাই কমে গেছে। ঈদের সময় তারা গ্রামে এলেও বর্তমান সামাজিক বিভাজন, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, সামাজিক মর্যাদাবোধ এবং ছোট-বড়দের মান-সম্মানবোধের জটিলতার কারণে আগের মতো মেলামেশা বা আড্ডার পরিবেশ আর দেখা যায় না। বাজারে আগে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রামবাসী সবাই একসঙ্গে মিশে যেত। কিন্তু সেই সংস্কৃতি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
আগে দুই ঈদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল খেলাধুলা, বিশেষত প্রীতি ফুটবল প্রতিযোগিতা। এসব খেলা সাধারণত অনুষ্ঠিত হতো স্কুল মাঠ, গ্রামের খোলা জমি বা কোনো প্রশস্ত স্থানে। এখন সেই মাঠগুলো আর নেই এবং খেলার মুক্ত পরিবেশও হারিয়ে গেছে। ফুটবল বা হাডুডুর মতো প্রতিযোগিতাগুলো সাধারণত স্থানীয় এবং প্রবাসী কর্মীদের (যারা দেশের বিভিন্ন শহরে কাজ করে) মধ্যে অনুষ্ঠিত হতো।
অথবা তরুণ ও প্রবীণ এবং বিবাহিত বনাম অবিবাহিতদের মাঝে। ঈদের দিন দুপুরে মাইকিং করে এসব প্রীতি-প্রতিযোগিতার ঘোষণা করা হতো, আর পরদিন বিকেলে তা শুরু হতো। কিন্তু এখন এসব খেলা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বর্তমান প্রজন্ম, বিশেষত ১৫-২৫ বছর বয়সীরা, এই ধরনের ঐতিহ্যবাহী খেলার সাক্ষীই হতে পারেনি। তারা এখন ৮-১০ জন মিলে মোটরবাইকে দূরবর্তী কোনো স্থানে ঘুরতে যায়। অনেকেই নানা নেশায় আসক্ত হচ্ছে বলে শোনা যায়। তারা কারও কথায় কান দেয় না এবং পরিবার ও সমাজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছেÑএমনটা স্থানীয়দের অভিমত।
গ্রামে ঈদের প্রাচীন উৎসবের রং যেমন ধূসর হয়ে গেছে, তেমনি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার আধ্যাত্মিক তাৎপর্যও অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে। রোজার ঈদে এখন সংযমের তুলনায় ইফতার মাহফিল (মূলত ইফতার পার্টি) এবং রাজনৈতিক কর্মকা- বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ইফতারের আয়োজন যেন এক ধরনের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পরিবর্তে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিস্বার্থের আধিপত্য বেড়েছে।
ঈদুল আজহার ক্ষেত্রে কোরবানির মূল উদ্দেশ্য সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জন এবং আত্মশুদ্ধি লাভ। পাশাপাশি হিংসা-বিদ্বেষ ও লোভ-লালসা থেকে মুক্তি পাওয়া। তবে এখন কোরবানির গরুর আকার এবং দাম নিয়ে আলোচনা হয়, যা মূল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুকে, এসবের প্রচার এখন অনেকের প্রধান আগ্রহ হয়ে উঠেছে।
শুধু কোরবানির গরুই নয়, ঈদের পর বড় নেতাদের সঙ্গে দেখা করা কিংবা তাদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রমাণও ফেসবুকে শেয়ার করা এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা দরিদ্র আত্মীয়স্বজনকে সহায়তা করার বদলে, সামাজিক মাধ্যমে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রদর্শনই যেন প্রধান হয়ে উঠেছে। দামি গরু কিনে, গলায় মালা পরিয়ে ছবি তুলে তা ফেসবুকের মাধ্যমে সবার কাছে প্রকাশ করার প্রবণতা এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ঈদের যে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যগত সৌন্দর্য, আন্তরিকতা, মাধুর্য এবং অকৃত্রিম বন্ধন ছিল তা আজ গ্রাম সমাজে খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন ব্যক্তিস্বার্থ, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ক্ষমতা প্রদর্শনই যেন ঈদের মূল রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঈদ আর সমষ্টিগত আনন্দের উৎসব নয়, বরং এটি ব্যক্তির স্বতন্ত্র উদযাপন এবং স্বার্থপর প্রচারের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছে।
গ্রাম বাংলার এই দৈন্যদশা থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য ও তাৎপর্য পুনরুদ্ধার করতে হলে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবার যৌথ প্রচেষ্টা আবশ্যক।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়