
সম্পাদকীয়
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বর্তমান নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। কিন্তু গত প্রায় আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার প্রক্রিয়া বারবার হোঁচট খেয়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল মিয়ানমার।
চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল। কিন্তু প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে, তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি তখন। পরে প্রত্যাবাসনও শুরু করা যায়নি। সে সময় নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, নিজ জমিতে ফেরার নিশ্চয়তাসহ ৮ দফা দাবি জানিয়েছিল রোহিঙ্গারা। এরপর ২০২৩ সালের অক্টোবরে চীনের মধ্যস্থতায় ১ হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়।
এর অংশ হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পৃথক পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ শেষ করে ডিসেম্বরে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া তালিকাভুক্ত ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার যোগ্য বলে জানিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমানকে এ কথা জানিয়েছেন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ইউ থান শিউ।
থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে শুক্রবার বৈঠক করেন তারা। বাংলাদেশ ২০১৮-২০ সালে ছয় ধাপে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের তালিকা দেয়। সেই তালিকা থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে নিঃসন্দেহে বড় অগ্রগতি।
ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনীতি, সামাজিক পরিবেশ, কক্সবাজার অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং আইনশৃঙ্খলার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। যদিও রোহিঙ্গা সংকট একটি আন্তর্জাতিক মানবিক সংকট। বিশ্ব সম্প্রদায়েরই এর দায়ভার বহন করা ছিল যুক্তিযুক্ত। শুধু খাদ্য কিংবা মানবিক সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণ কিংবা ভার লাঘব সম্ভব হতে পারে না।
রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা, মানবিক সহায়তা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি প্রায় দেড় মিলিয়ন রোহিঙ্গা অভিবাসীর চাপে কক্সবাজারের পরিবেশগত ও সামগ্রিক প্রভাব ও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফরশেষে যথার্থই বলেছিলেন, নিরাপদে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণভাবে স্বদেশে ফিরে যাওয়াই রোহিঙ্গা সংকটের প্রাথমিক সমাধান।
আমাদের প্রত্যাশা, এক লাখ আশি হাজার রোহিঙ্গা যথাসম্ভব স্বল্প সময়ের ভেতর মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনে সমর্থ হবেন। তাছাড়া বাংলাদেশে আশ্রিত প্রত্যেক রোহিঙ্গারই স্বদেশে ফিরে যাওয়ার অধিকার রয়েছে। মিয়ানমার সরকার কোনোভাবেই তাদের এই মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে পারে না।