
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা নতুন বাংলাদেশে অন্য মাত্রার ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছি। সিয়াম সাধনার রমজান মাত্র অতিক্রম আর বিদায়ের মধ্য পবিত্রতম ঈদ আমাদেরকে নানাভাবে মাতিয়ে ও নাড়িয়ে দিয়েছে। ধর্মীয় ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা আবহমান বাংলায় বরাবরই সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যাকে যুগ-যুগান্তরের সমৃদ্ধ বাতাবরণের নির্মল আবহে অস্ট্রিক জাতিসত্তার নিয়ামক বললে বেশি অতিকথন নয় কিন্তু।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির প্রবল দাপটে সবার আগে আঘাত লাগে ধর্মীয় সম্প্রীতিতে। তেমন উগ্র কষাঘাতে জাতিসত্তার যে ক্রমাবনতি তাও এই বরেন্দ্র ভূমির অসহনীয় দুর্বিপাক। দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ শাসন-শোষণ উপমহাদেশের নির্মল প্রতিবেশের যে সুদূরপ্রসারী অপঘাত, তারই বিপন্ন পরিস্থিতিতে পাকিস্তান-ভারত নামে দুটো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের উত্থান ঐতিহাসিক নিয়মের পালাক্রম, তা সন্দেহ নেই। তবে সাংস্কৃতিক আর যাপিত জীবনের হরেক ভিন্নতাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে সময় লাগেনি। দূর-দূরান্তে পাকিস্তান শাসকের শাসনামল ঝঞ্ছাবিক্ষুব্ধ প্রতিবেশের আরেক নবযাত্রা তো বটেই।
প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে জাতীয় ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় মাত্রা দেওয়ার নানামাত্রিক আলাপ-আলোচনা। তেমন বাতাবরণে পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্ব ছিল হাজার মাইলের। ফলে শুধু ভৌগোলিক সীমানাই নয় বরং জাতি আর সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো সামনে আসতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তান আয়তনে বড় হলেও বাংলাদেশ জনসংখ্যায় কেন এগিয়ে থাকে। ভাষার তেমন বিরোধপূর্ণ প্রশ্নে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার বিতর্ক ও চলমান অবস্থার আরেক ঝড়ের পূর্বাভাস। যা ভাষার প্রশ্ন থেকে ভৌগোলিক সীমানায় আঁচ লাগতে সময় লাগেনি। তেমন যাত্রাপথের ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ’৬৬ সালের নতুন কিছু কার্যক্রম উপস্থাপন আর ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান।
ইতিহাসের পাতাকে চিরস্থায়ী রূপ দেওয়া যথার্থ নিয়মের অনুষঙ্গ তো বটেই। সেখান থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাসের অস্থিরতার পালা শেষ করে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার নব সূর্যোদয় জাতির জন্য এক আকাক্সিক্ষত বিষয় তো ছিলই। সেটাও নানামাত্রিক কোন্দলে সম্প্রীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ২৪ বছরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল জাতিকে সুস্থির পর্যায়ে দৃশ্যমান করেও কাঠামোর গভীরে কত ক্ষতচিহ্ন নীরবে-নিঃশব্দে বাসা বাঁধছে তা বুঝতেও জাতিকে সময় ক্ষেপণ করতে হয়েছে, যুগেরও অধিক সময়।
সর্বশেষ সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক নির্বাচনে ২০০৯ সালে যে সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইতিহাস বিকৃতির ধারায় স্বৈরশাসনের পাঁয়তারা শুরু করে দেয়। সুদীর্ঘ ১৬ বছরের দুঃশাসন, অপঘাত, নিঃশব্দ অচলায়তনে গণতন্ত্র- ধারাবাহিক নির্বাচনের বিপরীত স্রোতে নিয়ে যায়। তাতে মূল শিকড় শুধু পশ্চাদপদই নয় ধসে পড়ার উপক্রম হতে সময় লাগলেও কোনো এক সময় উদীয়মান তরুণ প্রজন্মের নবতর আন্দোলন আর বিপ্লবে নতুন ও ভিন্ন মাত্রার আধুনিক বাংলাদেশ তৈরির যে সময়োচিত উত্থান, তাও ঐতিহাসিক পালাক্রমের ন্যায্যতা ছিল বৈকি।
কোনো অনিয়ম আর স্বৈরাচার দীর্ঘস্থায়ী বাতাবরণ থেকে ছিটকে পড়া সমৃদ্ধ ইতিহাসের দায়বদ্ধতা। আর সেই দুঃসময়েই আধুনিক ও নব প্রজন্ম শিরদাঁড়া উঁচু করে কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নিজেদের লড়াই বিপ্লবকে একীভূত করে দিতে পেছন ফিরে তাকাইনি পর্যন্ত। যে কোনো সমাজের উদীয়মান তরুণ প্রজন্ম জাতির জন্য সবচেয়ে বড় নিয়ামক শক্তি।
যুগ-যুগান্তরের সমাজ বিশ্লেকদের লেখায় স্পষ্ট ও আলোচিত এক বিষয়। আরব মনীষী ইবনে খালদুনই চতুর্দশ শতকে প্রথম বললেন, ‘যে কোনো শাসনকাল ১২০ বছরের চেয়ে বেশি হলে নৈরাজ্য, হানাহানি আর ধসের কিনারায় চলে যেতে কোনোদিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পর্যন্ত নেই।’ ইতিহাসই বহুবার তেমন সত্য আর তথ্যকে প্রমাণ করতে বারবার সফল হয়েছে। তাই বিশ্বের প্রাথমিকভাবে রাজন্যবর্গ পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত শাসকরা সেটাকে মান্যতা দিতে গণতন্ত্র আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে একটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকরই ছিলেন।
ইতিহাসের চিরাচরিত নিয়ম ভাঙা হলে ইতিহাসই তার দায়ভাগ তুলে নেয়। যা আমাদের বাংলাদেশের ১৬ বছরের লাগাতার দুঃশাসন, নির্বাচনের নামে প্রহসন আর সার্বিক জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাহীনতার চরম দুর্বিপাকে যেন পুনরায় চলমান ইতিহাসের ধারায় বিচারিক প্রক্রিয়ায় হাজির হতে সময় নেয়নি। তারই যথার্থ ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় আধুনিক ও নতুন প্রজন্মের হাত ধরে যে অনন্য বাংলাদেশের নব অভ্যুদয়ে জয় জয়কারে অবগাহন, তাও এই বরেন্দ্র অঞ্চলের যথার্থ ও শুভ শক্তির নবযাত্রা তো বটেই।
আমরা এখন তেমন যাত্রাপথ পার হওয়ার পালাক্রমে আর এক সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রত্যাশায় অধীর আগ্রহে দিন গুনছি। তবে সার্বিক বিবেচনায় সব কিছু সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক অবস্থায় মিলে যাবে তাও সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া। ষোলো বছরের জঞ্জাল মাত্র কয়েক মাসে সমূলে উপড়ে ফেলা যাবে সেটা আশা করাও বাতুলতা মাত্র। খারাপ প্রতিপত্তির আসক্তিকে জাতি যে মাত্রায় বিভোর হয়। ঠিক তার উল্টো দিকে ভালো আর মঙ্গল যাত্রা ততখানি অবাধ আর নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
অর্থনীতিবিদ ফ্র্যাঙ্ক বলেছিলেন, ‘উন্নয়ন এবং অনুন্নয়ন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ’। অর্থাৎ যে লাগাতার সমৃদ্ধি সমাজকে এগিয়ে নেয় সেখানে বিপরীত প্রদাহও সমানভাবে ক্রিয়াশীল। বিজ্ঞানী নিউটনের সেই তৃতীয় সূত্রের মতো- প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। যা শুধু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নয় সামাজিক ক্রমবিকাশেরও মূল ভিত্তি, তা অস্বীকার করার জো’ই নেই। কারণ আমরা অতিক্রম করছি দীর্ঘ অপশাসনের নানামাত্রিক উল্টো রথকে। যা সামলানো ছিল সত্যিই কঠিন।
মঙ্গলময় অনুভবে বিপরীত প্রদাহকে অনুকূল স্রোতে ফেরাতে হলে প্রয়োজনীয় সংস্কার অত্যাবশ্যক। তার ব্যতিরেকে নির্বাচন জনগণের অনুকূলে থাকবে কি না সেটাও তীক্ষ্ণ বিচার, বুদ্ধিতে বিশ্লেষণ করা পরিস্থিতির ন্যায্যতা। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তেমন সংস্কার প্রক্রিয়াকে সামনে এনে ভেতরের হরেক আবর্জনাকে উপড়ে ফেলতে সহৃদয় বিবেচনায় এগিয়ে যাচ্ছেন। যা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ঐকমত্যে সামনের যাত্রাপথকে নির্বিঘ্ন, আর নিরাপদ বলয় তৈরি করবে। নিরবচ্ছিন্ন কর্মযোগে ভবিষ্যতের পথরেখাকে নির্বিঘ্নে এগিয়েও দেবে।
নাজনীন বেগম/রাকিব