
ঈদ এক বিশেষ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব, যা দেশজুড়ে সকলের হৃদয়ে আনন্দ ও ঐক্যের বার্তা বয়ে আনে। সমাজের এক অঙ্গ পথশিশুরাও এই আনন্দের অংশীদার হতে পারেন। বিভিন্ন এনজিও, সমাজসেবী ও স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার উদ্যোগে পথশিশুদের জন্য বিশেষভাবে আয়োজন করা হয় ঈদের আনন্দের কিছু মুহূর্ত, যা তাদের জীবনে স্বস্তি ও আশা নিয়ে আসে। ঈদুল ফিতর বা ঈদের দিন প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে এক বিশেষ মর্যাদা রাখে। এটি শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা বা পারিবারিক মিলন নয়, বরং নতুন পোশাক, মুখরোচক খাবার, আনন্দের পরিবেশ ও একাত্মতার উৎসব হিসেবে বিবেচিত। তবে এ আনন্দের মেলা যেখানে অনেক পরিবারের জন্য উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত বয়ে আনে, অন্যদিকে সমাজের এক শোষিত অংশ– পথশিশুরাও ঈদের দিনটি উপলব্ধি করে এক ভিন্ন রূপে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোর পার্থক্যের কারণে অনেক পথশিশুর কাছে দিনটি কেবল একটি অপরিসীম স্বপ্নের মতো থেকে যায়। পথশিশুরা, যারা প্রায়ই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, তেমন কিছু শিশু আছে যারা তাদের জীবনের শুরু থেকেই সংগ্রাম ও নির্যাতনের মুখোমুখি। তাদের জন্য প্রতিদিনের জীবনই এক কঠিন বাস্তবতা। খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাথ ওভারব্রিজ ও বস্তিতে বসবাস করতে করতে তারা রাতের জেগে থাকে ক্ষুধা, আবহাওয়ার দুরাবস্থা এবং সামাজিক অবহেলার মধ্যে।
বর্তমান সময়ে বিভিন্ন এনজিও, সমাজসেবী ও স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা চেষ্টা করে যাচ্ছে পথশিশুদের জীবনে একটু হলেও আনন্দের সঞ্চার করতে। তারা নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে পথশিশুদের মাঝে শুধু উপহার বিতরণ করেন না, বরং শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প শোনা, কারুশিল্প কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের মনোভাব এক নতুন দিশা দেন। তাঁদের ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও সময় দেওয়ার মাধ্যমে তারা শিশুদের মনে এই বার্তা প্রেরণ করেন যে, সমাজ তাদের ভুলে যায়নি। এভাবেই সামান্য হলেও একটি সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। যেখানে পথশিশুরাও যেন সমাজের একটি অংশ হয়ে ওঠে। তাদেরও অধিকার আছে আনন্দ উপভোগ করার।
অধিকাংশ ধনী ব্যক্তিরা তাদের ব্যক্তিগত আনন্দে এতটাই মত্ত থাকেন যে, পথশিশুদের কষ্ট তাদের কাছে প্রায় অজানা। এ ধরনের সামাজিক অসমতা দূর করতে হলে আমাদের সকলের উচিত একটু সহানুভূতি প্রদর্শন করা। ছোট ছোট সহযোগিতাই হতে পারে একটি বিশাল পরিবর্তনের সূচনা। সমাজের সকল স্তরের মানুষের উচিত প্রতিটি ঈদে একটু হলেও সেই অংশীদারিত্ব দেখানো, যাতে করে পথশিশুদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এমনকি বিদ্যালয়, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোও যদি এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে সমাজের প্রতিটি কোণে মানবতার আলো ছড়িয়ে পড়বে।
সরকারেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। নীতি-নিয়ম ও বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে যদি পথশিশুদের জন্য নিয়মিত সুবিধা ও উৎসবের আয়োজন করা যায়, তবে দীর্ঘমেয়াদে সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিছু জেলা ও মহানগরীতে ইতোমধ্যে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেখানে স্থানীয় প্রশাসন এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে মিলে কাজ করছে। এসব উদ্যোগের সফলতা দেখিয়ে, অন্যান্য অঞ্চলেও একই রকম সহযোগিতা নিশ্চিত করা যায়।
ঈদ উদযাপন শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি মানবতার এক ন্যায়বিচার ও সহমর্মিতার প্রতীক। যখন সমাজের ধনী অংশ এবং সচেতন নাগরিকরা নিজেদের আনন্দ ভাগ করে নেন, তখনই সত্যিকারের অর্থে ঈদের আনন্দ প্রকাশ পায়।
পথশিশুদের জন্য যদি প্রতিটি ঈদে সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে সামান্য হলেও আশার আলো সঞ্চার হয়, তাহলে তারা বুঝতে পারবে, এই পৃথিবীতে এখনো ভালোবাসা, সহানুভূতি ও মানবিকতা বেঁচে আছে। তাদের ছোট ছোট হাসি, আনন্দের চোখের ঝিলিক, একটি নতুন সূর্যোদয়ের মতো তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে। এই পরিবর্তন কেবল তাদের ব্যক্তিগত জীবনে নয়, বরং সমাজের বৃহত্তর পরিসরে ন্যায়বিচার ও মানবতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
ঈদ হল ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও মানবিকতার উৎস। যখন আমরা নিজেদের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে অন্যদেরও আনন্দ ভাগ করে নিই, তখনই আমাদের সমাজে এক নতুন সংহতি ও মিলনের ভাবনা সঞ্চারিত হয়। পথশিশুদের ক্ষেত্রে, সেই ছোট ছোট উদ্যোগগুলো তাদের মনে এক নতুন প্রেরণা জাগিয়ে তোলে। তাদের মুখের হাসি আমাদের সকলের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। ভবিষ্যতে যদি আমরা পথশিশুদের জন্য আরও উন্নত, সুসংগঠিত ও দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করি, তবে তাদের জীবনে শুধু একদিনের আনন্দের নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের সূচনা হবে। আমাদের সমাজের প্রত্যেকটি নাগরিকের উচিত এই বিষয়টি উপলব্ধি করা যে, সমাজের প্রতিটি সন্তান- যারা ধনী পরিবারে জন্ম নেয় বা যারা পথের মাঝে জন্ম নেয়- তাদের অধিকার সমান।
সমাজের ধনী ব্যক্তি, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থাগুলো যদি একত্রে হাত বাড়িয়ে এই উদ্যোগে অংশ নেয়, তাহলে পথশিশুদের জীবনে পরিবর্তনের সূচনা সম্ভব। এ ধরনের উদ্যোগ শুধু একদিনের খুশির উৎস নয়, বরং এগুলো শিশুদের মানসিক ও শারীরিক উন্নয়নের জন্য এক প্রাথমিক ধাপ হিসেবে কাজ করবে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি- পথশিশুরাও আমাদের সমাজের অংশ। তাদের প্রতি সহানুভূতি, ভালোবাসা ও সমবেদনা প্রকাশ করা আমাদের নৈতিক কর্তব্য। স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি সেন্টারের মাধ্যমে এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে করে সবাই জানে, ঈদ উদযাপনের আনন্দ কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজের প্রতিটি কোণে পৌঁছাতে পারে। সরকার ও এনজিওদের উচিত, একবারের উদ্যোগের পরিবর্তে নিয়মিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যাতে পথশিশুরা প্রতি ঈদে বা বিশেষ উপলক্ষে তাদের জীবনে কিছুটা হলেও আনন্দের ছোঁয়া পায়। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন দিক থেকেই সাহায্যের হাত বাড়ানো যেতে পারে। এ ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যতে শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশে সহায়ক হবে।
পথশিশুদের কাছে ঈদ শুধু নতুন পোশাক, উপহার ও স্বল্প সময়ের আনন্দের উৎস নয়; বরং এটি তাদের জীবনে এক নতুন আশার বার্তা, এক মানবিক বন্ধনের প্রতীক। সমাজের প্রতিটি কোণে, যেখানে একদিকে আনন্দের দীপজ্যোতি জ্বলে, সেখানে অসংখ্য পথশিশু একাকী ও নিরর্থক জীবনের বেদনায় ভোগে। কিন্তু সামাজিক উদ্যোগ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও দাতব্য কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা যদি তাদের জীবনে সামান্য হলেও সুখের সঞ্চার করতে পারি, তাহলে তা কেবল তাদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্যই এক আশার সুরভি নিয়ে আসতে পারে। আমরা সবাই যদি সামান্য হলেও এগিয়ে এসে পথশিশুদের পাশে দাঁড়াই, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে সাহায্য করি, তাহলে সমাজে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। যেখানে প্রতিটি শিশুর জীবনে থাকবে আশার আলো, ভালোবাসার স্পর্শ ও মানবিকতার বন্ধন। এই পরিবর্তন কেবল একটি দিনের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের প্রতিটি ঈদে স্থায়ী প্রভাব ফেলবে। আসুন আমরা সবাই মিলেমিশে এ প্রতিশ্রুতি দেই- পথশিশুদের ঈদকে নিজস্ব ঈদের মতো করে তুলি, যাতে করে তাদের জীবনেও আসতে পারে সেই অমূল্য আনন্দ, যেটি আমাদের প্রত্যেকের জীবনে উৎসবের মুহূর্ত নিয়ে আসে। এই প্রচেষ্টাই হবে সমাজকে আরও মানবিক, আরও সহানুভূতিশীল এবং আরও একাত্ম করে তোলার পথ।