ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ চৈত্র ১৪৩১

সম্মিলনের যাত্রা হোক নিরাপদ ও স্বস্তির

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৭:৫৫, ২৯ মার্চ ২০২৫

সম্মিলনের যাত্রা হোক নিরাপদ ও স্বস্তির

 

ঈদ মুসলিম জাতির গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব। এর রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষের ঈদ শোকে পরিণত হয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এজন্য সরকারকে নিতে হবে নানামুখী পদক্ষেপ। ইতোমধ্যে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করাসহ সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এসব কঠোরভাবে কার্যকর করতে এবং সকলকে মেনে চলতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রতি বছর ৮০ লাখ থেকে ১.১৫ কোটি মানুষ ঈদ উদযাপনের জন্য রাজধানীর বাইরে যাতায়াত করেন। তবে এবারের ঈদে আরও বেশি লোকের সমাগম হবে। ঈদের সময় বিগত কয়েক বছর অতীতের তুলনায় কম লোক বাড়ি ফিরেছে। কোভিড-১৯ বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ঈদ ভ্রমণ কম ছিল। এখন কোনো মহামারির প্রাদুর্ভাব নেই। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে ভ্রমণের গতি আরও বেড়েছে। সরকারি কর্মচারীরা ২৮ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ দিনের ছুটি উপভোগ করার সুযোগ পাবেন, যার মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটিও থাকবে। ফলে এই ঈদে মানুষের আসা-যাওয়া বাড়বে।
বিপুল শহরবাসী গ্রামে ছুটে যায় নাড়ির টানে গ্রামের বাড়িতে সবাইকে নিয়ে ঈদ উদযাপনের জন্য। তাদের আগমনে প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে গ্রামের হাটবাজার, দোকানগুলো। নতুন রক্ত সঞ্চারিত হয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে। যদিও পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলিম সমাজের প্রধান উৎসব, তবু অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মধ্যে ঈদ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। ধনী থেকে দরিদ্র-সমাজের সর্বস্তরের লোক সারা বছরের দুঃখ-কষ্ট ভুলে এই দিনটিতে যে যার সাধ্যমতো খুশিতে মেতে ওঠে। সমাজের বিত্তবান মানুষের দায়িত্ব একটু বেশি। তাঁরা যেন গরিব মানুষের জন্য কিছু করে। যাতে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে। সকলকে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে, যাতে ঈদ আনন্দের হয়ে ওঠে সকল পরিবারের জন্য।   
ধারণা করা হচ্ছে যে, এই ঈদে আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ মানুষ গ্রামের বাড়িতে যাবে। ঈদের ছুটির আগে এবং পরে কয়েকদিন তীব্র যানজটের সম্ভাবনা রয়েছে। অসহনীয় যানজটের কারণে যাত্রীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এছাড়াও ভাড়া বিশৃঙ্খলা, যাত্রী হয়রানি এবং যানজটের কারণে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ২০২৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ৬ হাজার ৯২৭টি যানবাহন দুর্ঘটনার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে। গবেষণায় ৭ হাজার ২৯৪ জন নিহত এবং ১২ হাজার ১৯ জন আহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৬ হাজার ২৬১টি সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৭ হাজার ৯০২ জন নিহত এবং ১০ হাজার ৩৭২ জন আহত হয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার খুবই উদ্বেগজনক।
সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে? প্রতি বছর ঈদ যাত্রা নিয়ে নানাভাবে বিতর্ক এবং সমালোচনা করা হয়। তবে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা এবং যাত্রী দুর্ভোগের সংখ্যা কমেনি। যদিও সড়কের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে, তবু কি সাধারণ মানুষ আসলে এর থেকে উপকৃত হতে পেরেছে? দুর্ঘটনা বা দুর্ভোগ কমাতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে দক্ষ নীতিমালা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়কে নিবন্ধিত গাড়ির চেয়ে অনিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা কম নয়। যা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অনেকটা দায়ী। সরকারি নির্দেশ সত্ত্বেও পৌরসভা এবং জাতীয় রুটে ট্রাই-হুইলার, মোটরসাইকেল এবং ইজিবাইক চলাচল করছে। অনেকের মতে, এর ফলে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ২০-২৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মতে, গত বছর ঈদের জন্য এক কোটির বেশি মানুষ ঢাকা থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন। এছাড়াও প্রায় ৫-৬ কোটি মানুষ বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করেন। এছাড়াও ঈদ বাজার এবং গ্রামের বাড়িতে ভ্রমণের মতো বিভিন্ন কারণে সারা দেশে অতিরিক্ত ৫-৬ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের পরিবহনে ভ্রমণ করতে পারে। সরকারের অসংখ্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি। অব্যবস্থাপনা এবং সড়কে যানজট এই বছরও ঈদ ভ্রমণকে অপ্রীতিকর করে তুলতে পারে। এটি অনেক মানুষের বাড়িতে ঈদের আনন্দকে ব্যাহত করতে পারে। ভ্রমণের সময় আমাদের সকলের এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন থাকা উচিত। ঈদ যাত্রায় দুর্ভোগ নিরসনের জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা করা গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, অঞ্চল ভিত্তিক পোশাক শ্রমিকদের ঈদ ছুটি দেওয়া উচিত। বিভিন্ন স্থানে কর্মচারীরা একই সময়ে ছুটি পেতে পারে না। ফলে গাড়িতে ভ্রমণকারী লোকের সংখ্যা কম হবে। ঈদযাত্রাকে আরও সুন্দর করার জন্য রাস্তা সংস্কারের কাজ অবিলম্বে সম্পন্ন করা উচিত। তবে ঈদের অন্তত তিন দিন আগে যে কোনো ধরনের রাস্তা নির্মাণ বা সংস্কার বন্ধ করা উচিত। ঈদের তিন দিন আগে এবং পরে চাহিদার ভিত্তিতে বিশেষ লঞ্চ বা ট্রেনের সময়সূচি নির্ধারণ করা উচিত। ঈদের সময় মানুষের কষ্ট বা হয়রানি কমাতে সরকারের যথেষ্ট প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। ঈদ ভ্রমণ যাতে আরামদায়ক হয় তা নিশ্চিত করার জন্য, বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা কার্যকর ও জনগণের স্বার্থে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিভাগীয় শহরে যানজটের কারণে এই ঈদের ছুটিতে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে পারেন। রাজধানীসহ প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সমস্ত সড়ক হকার এবং অবৈধ পার্কিং থেকে মুক্ত করতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ এবং পরিবহন সমস্যার ফলে গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কিছু পরিবহন মালিক-চালক বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অসাধু পরিবহন মালিক এবং চালকদের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্রিয় তৎপরতা প্রয়োজন।
অতীতে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে ঈদ ভ্রমণে দ্বিগুণ বা তিনগুণ অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিশৃঙ্খলা দেখতে পেয়েছি। যাত্রীদের হয়রানি এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে এটি কেবল সড়কেই নয়, বরং গাড়ির টিকিটের দামের বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি, সারাদেশে জাহাজ ও ফেরি চলাচলের সঙ্গে জড়িত ইজারাদাররা ঈদের সময় যাত্রী পারাপারে অতিরিক্ত টোল আদায় করে। এবারও তারা সক্রিয় হতে পারে। যাত্রী হয়রানি রোধে, নৌ ও সড়ক মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ করা উচিত। অতিরিক্ত লোক তোলা বা ওঠানো রোধ করে নৌ-দুর্ঘটনা বন্ধ করার ক্ষমতা নৌ-পুলিশের রয়েছে।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা হাইওয়েতে অধিকতর নজরদারি জরুরি। যাতে উচ্চ গতিতে বেআইনিভাবে গাড়ি চালানো রোধ করা যায়। কারণ, বিগত বছরগুলোতে এ সড়কে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার ফলে যথেষ্ট প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এটি সত্যিই হতাশাজনক। ঈদের সময় এ সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। সড়কে গাড়ির গতির সর্বোচ্চ সীমা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ কারণে স্পিডগান, যা স্পিড ডিটেক্টর ডিজিটাল মেশিন নামেও পরিচিত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে থাকা উচিত। অথবা যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাস্তায় কঠোরভাবে ব্যবহার করা উচিত। যদি কোনো চালক খুব দ্রুত গাড়ি চালান তবে এই মেশিনে শনাক্ত করা যাবে এবং চালককে শাস্তি এবং জরিমানা করার আইন বা বিধি থাকতে হবে।
এছাড়াও ফেরিগুলোর সঠিকভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এই ঈদে কালবৈশাখীর ভয়ে নদীপথ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তাই ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ বা নৌকা নদীপথে চলাচল বন্ধ করা প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ মনিটরিং বাড়াতে হবে। প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ ঢাকার ওপর চাপ কমানোর একটি ভালো উপায়। বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ঢাকায় যানজট কমবে। এর ফলে সকলেই লাভবান হবে। বিকেন্দ্রীকরণের পদক্ষেপ নিলে সড়ক ও নদীপথের দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলে বিশ্বাস করি।
 
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

×