
ইসলামে মুসলমানদের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা দুটি বিশেষ আনন্দের দিন নির্ধারণ করেছেন: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এই দুটি ঈদের দিন মুসলিমদের জন্য একদিকে যেমন অত্যন্ত খুশি ও আনন্দের, অন্যদিকে ইবাদত, তাকবির, নামাজ, দান-সদকা এবং পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সামাজিক বন্ধন তৈরি ও সুদৃঢ় করার। অধিকন্তু, সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ঈদ আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যেই ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য ও সার্থকতা প্রকাশ পায়। কিন্তু বাস্তবের ঈদচিত্রে দেখা যায় ভিন্নতা। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল, এতিম, গৃহহীন, পথশিশু, একাকী ও যুদ্ধবিধ্বস্তদের ঈদ আনন্দের না হয়ে, বরং হয়ে উঠে বেদনার। তখনই সমাজ থেকে ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য ও সার্থকতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলোর ঈদ হয় জমকালো ও আনন্দময়। ঈদের প্রস্তুতি, কেনাকাটা, সাজসজ্জা সবটাতেই থাকে এক আলাদা উচ্ছ্বাস। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় ঈদের আমেজ। নতুন দামি পোশাক, নানারকম সুস্বাদু খাবার, ঈদের নামাজ, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানো, উপহার বিনিময় ও ঘোরাঘুরির মাধ্যমে ঈদের আনন্দ উপভোগ করেন তারা। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ঈদ উদ্যাপন কিছুটা হিসাব-নিকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থের সঠিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা সাধ্যমতো ঈদের আনন্দ উপভোগ করেন। তাদের দামি পোশাক বা বিলাসবহুল আয়োজনের পরিবর্তে থাকে পারিবারিক ভালোবাসা ও আত্মীয়তার বন্ধন, যা তাদের ঈদকে আনন্দময় করে তোলে। সামর্থ্যরে মধ্যে থেকেই ঈদের আনন্দ খুঁজে নেন তারা। অপরদিকে, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের জন্য ঈদ মানেই এক বেদনাদায়ক বাস্তবতা। নতুন জামা, ভালো খাবার, উপহারÑ এসব তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। প্রতিদিনের আয় বা দিনমজুরি দিয়ে যেখানে তাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে যায়, সেখানে ঈদের আনন্দের জন্য খরচ করা তাদের জন্য এক ধরনের বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়। যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অগ্রাধিকারগুলোর সঙ্গে বড় বেমানান। তাই, তাদের ঈদ কাটে পুরানো জামা-কাপড়ে, ছেলেমেয়েদের দেওয়া মিথ্যে আশ্বাসে এবং ভালো কিছু রান্না বা প্রতিবেশীদের দেওয়া খাবারের আশায়।
এতিম ও পথশিশুদের ঈদ কাটে এক ভালোবাসা ও স্নেহহীন নির্মম বেদনায়। বাবা-মা ছাড়া ঈদ অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কাছেই ঈদ বলে মনে হয় না। সেখানে এতিম বাচ্চাদের মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলেই জীবন থমকে যায়। এতিমখানায় থাকা শিশুরা হয়তো নতুন জামা পায়, একটু ভালো খাবার পায়, কিন্তু বাবা-মায়ের আদর ও ভালোবাসার অভাব তাদের ঈদের আনন্দকে পরিণত করে দেয় বেদনায়। বাবা-মার আদর-ভালোবাসা ছাড়া জীবন তাদের জন্য এক বিরাট পরীক্ষা। অন্যদিকে, যারা এতিমখানাতেও ঠাঁই পায় না, যারা খোলা আকাশের নিচে বেড়ে ওঠে, তাদের ঈদ যেন আরও নির্মম। ঈদের দিন তাদের মধ্যে থাকে এক মুঠো ভালো খাবার জোগাড় করার প্রতিযোগিতা। মসজিদ, হোটেল ও রেস্তোরাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তারা খুঁজতে থাকে মানুষের সহানুভূতি, একটু ভালো খাবার, ভালো জামা ও কিছু আর্থিক সাহায্য। কিছুটা পেলেই তাদের মুখে ফুটে ওঠে নির্মল হাসি। তাদের থাকে না কোনো নতুন পোশাকের উচ্ছ্বাস, আনন্দের ঝলক বা পরিবারের উষ্ণতা।
অনেকেই জীবিকার তাগিদে প্রিয়জনদের ছেড়ে বিদেশ-বিভূঁইয়ে অবস্থান করছেন বা কেউ কর্মব্যস্ত জীবনে একাকী হয়ে গেছেন। তাদের ঈদ মানেই নিঃসঙ্গতা, স্মৃতির আক্ষেপ, আর দূর থেকে আপনজনদের আনন্দ দেখার বেদনা। প্রবাসীরা দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে পরিবারকে সুখী করার চেষ্টা করেন। তাদের পাঠানো অর্থে পরিবারের সদস্যরা নতুন পোশাক পরে, সুস্বাদু খাবার খায় এবং আনন্দে মেতে ওঠে। কিন্তু প্রবাসী ব্যক্তিটি ঈদের দিনটি কাটান নিঃসঙ্গতায় ও বেদনায়। ব্যস্ততার ফাঁকে হয়তো পরিবারকে ভিডিও কলে শুভেচ্ছা জানান, কিন্তু কাছের মানুষদের সঙ্গে ঈদ কাটানোর সৌভাগ্য তাদের হয়ে ওঠে না। শুধু প্রবাসীরাই নন, সমাজের অনেক প্রবীণও ঈদের দিন কাটান একাকীত্বের মধ্যে। অনেক বাবা-মা বাস্তবের নিষ্ঠুরতায় বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছেন। পরিবার থেকে তারা একেবারে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু একদিন এই পরিবারকে ভালো রাখার জন্য তারা নিজেদের সব সুখ-স্বপ্ন ত্যাগ করে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। যারা একদিন পরিবারের সকলের সব ঈচ্ছে-আকাক্সক্ষা পূরণ করেছেন, তারা পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে গেছেন এবং তাদের ঠিকানা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। ঈদ তাদের কাছে দুঃখ, বেদনা, স্মৃতি ও একাকীত্বে পরিপূর্ণ একটি সাধারণ দিন। সারাদিন আপনজনদের অপেক্ষায় থেকে স্মৃতিগুলোকে সঙ্গী করে ঘুমিয়ে পড়েন তারা। অসুস্থ মানুষদেরও ঈদ কাটে যন্ত্রণা ও বেদনায়। অনেক রোগী বিভিন্ন জটিল রোগ যেমনÑ হৃদরোগ, হেমোফিলিয়া, কিডনি ফেইলিওর ও ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে দুর্বিষহ কষ্ট ও যন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে আছেন। তাদের কাছে ঈদ মানে হয়তো সাধারণ আরও একটি যন্ত্রণা ও বেদনার দিন।
অনেক দেশের ঈদের আনন্দকে ম্লান করে দেওয়ার পেছনে রয়েছে যুদ্ধ, দখলদারিত্ব ও রাজনৈতিক সংকট। উদাহরণস্বরূপÑ ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক ও ইউক্রেনে বোমার শব্দে মানুষ ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তারপর আশ্রয়হীন ও ক্ষুধার্তভাবে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। অথবা প্রিয়জনের লাশ খুঁজতে থাকে অথবা লাশের পাশে বসে কাঁদে। তাদের কাছে ঈদের আনন্দ হচ্ছে আরও একদিন বেঁচে থেকে লড়াই বা বেঁচে থাকার লড়াই করা। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের ঈদ বছরের পর বছর ধরে ভিন্ন এক বাস্তবতায় কাটছে। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে হাজারো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। ২০২৫ সালের রমজানেও এই নৃশংসতা থামেনি। ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভেঙে ইসরাইল গাজার ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে ৭০০-এর বেশি নিরপরাধ নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে। জাতিসংঘের মতে, গাজায় এখন আর কোনো এলাকাই নিরাপদ নয়। ঈদের দিনে যেখানে শিশুরা নতুন জামা পরে আনন্দে মাতোয়ারা থাকার কথা, সেখানে গাজার শিশুরা হাত পেতে খাবার চায়, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া স্বজনদের খুঁজে বেড়ায়। শুধু ফিলিস্তিন নয়, সিরিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতেও ঈদের চিত্র প্রায় একই। এতটার পরও তারা সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখে, আশার আলো খোঁজে, শান্তির প্রত্যাশা করে এবং ঈদ উদ্যাপনের চেষ্টা করে।
ঈদ যদি শুধু ব্যক্তিগত আনন্দের উৎসব হয়, তবে তা প্রকৃত সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে। আমাদের উচিত, ঈদের আনন্দ শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। আমরা যদি জাকাত, ফিতরা, দান ও সহানুভূতির মাধ্যমে দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের পাশে দাঁড়াই, এতিম ও পথশিশুদের ভালোবাসা ও স্নেহ প্রদান করি, নিঃসঙ্গ ব্যক্তি ও প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি, বৃদ্ধাশ্রমে থাকা প্রবীণদের সঙ্গে সময় কাটাই এবং ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের জন্য দোয়া ও সহায়তা করি, তাহলেই ঈদ সত্যিকার অর্থে সবার জন্য ঈদ হয়ে উঠবে বলে আশা করতে পারি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
[email protected]