
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ’।
গানটির সাথে মিশে আছে চিরাচরিত মধুময় শৈশবের ঈদ উৎসব। পবিত্র মাহে রমজানের শবেকদরের রাত থেকেই শুরু হয়ে যেত ঈদের আমেজ। সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে সবার মাঝে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো।কখন ঘোষণা আসবে নতুন চাঁদ দেখা গেছে আর কাল ঈদ। ঘোষণা আসার সাথে সাথেই মহল্লায় হৈচৈ পড়ে যেত।আর তার পরপরই বিটিভিতে বাজতে শুরু করতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ গানটি’।
ঈদ শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি সামাজিক ঐক্যের প্রতীক। সামাজিক ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মানুষ একে অপরের সাথে মিলিত হয়, পরস্পরের সাথে সুখ দুঃখ ভাগ করে নেয়। ঈদকে কেন্দ্র করে সবার মাঝে উৎসব ও আমেজের ভাব বিরাজ করে।
ঈদের আনন্দ প্রতিটা মুসলিম বিশ্বের ঘরে দেখা যায়। ঘরে ঘরে তৈরি হয় আনন্দঘন পরিবেশ। তবে বর্তমান সময়ে এমন আনন্দঘন পরিবেশ তেমন দেখা যায় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেকাল ও একালের ঈদের মাঝে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবর্তন ঘটেছে সেকাল ও একালের ঈদের আনন্দের মাঝেও।
সেকালে ঈদের নামাজ আদায় করে, খাবার খেয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া, বড়দের থেকে সালামি নেওয়া হতো। বর্তমান সময়ে ঈদের নামাজ আদায় করে আর কাউকে ঘুরতে দেখা যায় না। নানান ব্যস্ততায় এখন আর আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়া হয়ে ওঠে না। সকলের কাছে রয়েছে স্মার্টফোন যার মাধ্যমে ঘরে বসেই সারা বিশ্বের বড় বড় অনুষ্ঠান দেখে ঈদ উদযাপন করা হয়।
ঈদ হলো সেই দিন পালনের নাম, যা মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। ঈদ মানে ফিরে আসা। যেহেতু খুশির বার্তা নিয়ে ঈদ ফিরে আসে এবং মানুষ তা পালন করে। তাই তাকে ঈদ বলা হয়। দিনটি আনন্দ উচ্ছ্বাসে কাটিয়ে দেওয়া। যেখানে থাকবে না কোনো দুঃখ-দুর্দশা।
কিন্তু বর্তমান সময়ে এমন আনন্দঘন পরিবেশ দেখা যায় না। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গানটিও এখনকার শিশুরা যেন শুনতে চায় না। প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে ঈদের আনন্দও পরিবর্তন হয়েছে। ঈদের চাঁদ দেখার জন্য এখন আর কেউ অধীর আগ্রহে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না। এখন রয়েছে প্রতিটি দেশে আলাদা আলাদা চাঁদ দেখার কমিটি। তারাই মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে দেয় ঈদ কবে হবে।
বর্তমান সময়ে ঈদ উৎসব দেখার চেয়ে দেখানোর মানুষের সংখ্যা বেশি।কে কত টাকার বাজেট নিয়ে শপিং করতে এসেছে জনপ্রিয় ভাইরাল ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। একপ্রকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কার থেকে বেশি টাকার শপিং করতে পারে। আগেকার সময়ে ঈদের দিনে বাড়িতেই তৈরি করা হতো হরেক রকমের মজাদার খাবার। স্মার্ট ফোন না থাকার কারণে ছিল না কোনো কন্টেন্ট তৈরির প্রচেষ্টা কিংবা খাবারের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করার ট্রেন্ড। ছিল না অনলাইনে টিকিট কাটার সুযোগ, পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করে থাকতো।
আধুনিকতার যুগে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার থাকায় সামাজিক উৎসব হয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর হাতের পুতুল।কে কার আগে পোস্ট করবে,কার ছবি দেখতে সুন্দর হয়েছে, পোস্টে লাইক, কমেন্ট আরো কতকিছু!! এখন এসবের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পায় সবাই।
ঈদুল ফিতরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঈদি বা সালামি। নতুন পোশাক পরিধান করে নামাজ আদায় করে বড়দের থেকে সালামি নেওয়া ছিল ঈদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। যুগের পরিবর্তন আসলেও এ চিরাচরিত প্রথা এখনও বিরাজমান রয়েছে। তবে, এখন অনলাইনের মাধ্যমে সালামি নেওয়া হয়। মোবাইল ব্যাংকিং যেমন- নগদ, বিকাশের মাধ্যমে। ফলে দূর-দূরান্ত থেকেও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সালামি পৌঁছে যায়। এছাড়াও শিশুরা সিসিমপুর কার্টুন দেখে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠতো। বিচিত্রার কয়েকটি পৃষ্ঠা বরাদ্দ থাকত বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবীর কার্টুন দিয়ে।
তবুও ঈদ আসে, আমরা উদ্যাপন করি। কিন্তু যে ঈদ আমরা শৈশবে পালন করে এসেছি তার স্বাদ ডিজিটাল যুগের সকল সুযোগ সুবিধা পেয়েও পাই না। মায়ের মুখের মতো ভেসে আসে মধুময় শৈশবের কাটানো ঈদ। হয়তো একসময় পুরোপুরি হারিয়ে যাবে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য।।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়