
তিন বছর পূর্বে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এই যুদ্ধে রাশিয়ার অগ্রগতি স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড এখন রাশিয়া দখল করে নিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা ট্রাম্পের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উত্থাপিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হয়েছে ইউক্রেন। গত ১১ তারিখ সৌদি আরবের জেদ্দায় যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন সংলাপ শেষে একটি যৌথ বিবৃতিতে সম্মতির বিষয়টি জানানো হয়েছে। বৈঠকটির পর ইউক্রেনকে পুনরায় সামরিক সহযোগিতা এবং গোয়েন্দা তথ্য দিতে রাজি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে একটি অন্তর্বর্তী যুদ্ধবিরতি কার্যকর এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধের জন্য আলোচনা শুরু করতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হয়েছে ইউক্রেন। বৈঠকে নেতৃত্বদানকারী যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন, বল এখন রাশিয়ানদের কোর্টে। মস্কোর নিকট যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি নিয়ে যাওয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। রাশিয়া যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু তারা যদি এতে রাজি না হয় তাহলে দুর্ভাগ্যবশত সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা বুঝা যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সমুদ্র ও আকাশপথে আংশিক যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব দিয়েছেন তার বাইরে গিয়ে আমাদের প্রদত্ত প্রস্তাবটি হলো গোলাগুলি বন্ধ করা। পুতিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন। তবে তিনি বেশ কয়েকটি কঠিন শর্তও দিয়েছেন। শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছেÑকিয়েভ ন্যাটোর সদস্যপদ না পাওয়ার নিশ্চয়তা, ইউক্রেনে বিদেশী সেনা মোতায়েন নিষিদ্ধ করা এবং রাশিয়ার দখলকৃত ক্রিমিয়া ও চারটি অঞ্চলকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া। রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, ইউক্রেন যুদ্ধের মূল কারণ হলো ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণ, যা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটকে সমাধান করতে হবে। তবে মার্কিন কর্মকর্তরা আশঙ্কা করছেন, পুতিন এই যুদ্ধবিরতিকে ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
রাশিয়ার এসব দাবি শুধু ইউক্রেনের সঙ্গে নিছক একটি চুক্তি করার জন্য নয়, বরং পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা চুক্তির ভিত্তি তৈরি করা। শান্তির জন্য সকল শর্ত পূরণ করা আবশ্যক বলে পুতিন মনে করেন। তবে রাশিয়ার শান্তি চুক্তি বা যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভাঙার রেকর্ড রয়েছে। তাই এমন কোনো চুক্তি কার্যকরের জন্য শক্তিশালী একটি প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পও এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চান বলে তিনি উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। আশা করি প্রেসিডেন্ট পুতিনও রাজি হবেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে বলেন, যুদ্ধবিরতি একটি ইতিবাচক প্রস্তাব, যা কেবল আকাশ ও সমুদ্রপথে লড়াই নয়, যুদ্ধের সম্মুখ সারির জন্যও প্রযোজ্য। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, এটি ইউক্রেনের শান্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আমাদের সকলকে এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি স্থায়ী ও নিরাপদ শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য দ্বিগুণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তিনি আরও বলেন, রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে হবে এবং যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। যুদ্ধবিরতিতে ইউক্রেনের সম্মত হওয়ার সিদ্ধান্তকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্বাগত জানায়। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন বলেন, এটি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এমন পদক্ষেপ ইউক্রেনকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা বলেন, আসন্ন শান্তি আলোচনায় ইইউ তার অংশীদারদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত রয়েছে। তবে যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে পুতিনের প্রতিক্রিয়াকে ছলনা বলে অভিহিত করেছেন জেলেনস্কি। শান্তি চুক্তি জোরদার করার জন্য তিনি রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানান। এর আগে পুতিন বলেছিলেন, যুদ্ধের অবসান ঘটাতে তিনি রাজি আছেন। কিন্তু একটি যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংকটের অন্তর্নিহিত কারণগুলোর অবসান ঘটিয়ে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা উচিত বলে পুতিন মন্তব্য করেন। ট্রাম্প অবশ্য পুতিনের বক্তব্যকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কিন্তু অসম্পূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার গ্রুশকো বলেছেন, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোয় ইউক্রেনকে সদস্য করা হবে না এবং যে কোনো শান্তি আলোচনায় কিয়েভ নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকবেÑমস্কো এমন নিশ্চয়তা চায়। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই লৌহদৃঢ় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এই চুক্তির অংশ হোক। পুতিন বলেছেন, তিনি যুদ্ধবিরতির পক্ষে। তবে শান্তির জন্য বেশ কয়েকটি কঠিন শর্ত যুক্ত করতে চায় রাশিয়া। যার মধ্যে ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার দাবি রয়েছে। যদিও কিয়েভ ও তার মিত্ররা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে, তবে রাশিয়ার দাবি মেনে যুক্তরাষ্ট্র অস্থায়ীভাবে অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করলেও স্থায়ী সীমাবদ্ধতা আরোপ করেনি।
ট্রাম্প কিন্তু কূটনৈতিক সাফল্যের লক্ষ্যে ইউক্রেনের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে পারেন। পুতিন আলোচনায় দেরি করিয়ে ট্রাম্পের নিকট থেকে আরও সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের অভিযোগ, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকরে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা পুতিন ধ্বংস করতে চাইছেন। রাশিয়া ইউক্রেনের যেসব ভূমি দখল করেছে, সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সেই বিষয়টি কিভাবে সামাল দেওয়া হবে, এমন প্রশ্নের জবাব ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এড়িয়ে গেছেন। ট্রাম্প প্রশাসন নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে পরিচালনা করছেন তার সমালোচনা করে ইউক্রেনের সাবেক সেনাপ্রধান এবং বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত জালুঝনি মন্তব্য করেন, যুক্তরাষ্ট্র পুরো পশ্চিমা বিশ^ব্যবস্থার ঐক্যকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, রাশিয়ার হামলার পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু ইউরোপ হতে পারে বলে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার আলোচনা থেকে এটি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ক্রেমলিনের দিকে ঝুঁকছে এবং তাদের ছাড় দিতে চাইছে। তিনি আরও বলেন, আমরা যা দেখছি তা কেবল অশুভ অদক্ষ এবং রাশিয়াই বিশ^ব্যবস্থাকে বদলে দিতে চেষ্টা করছে তা নয়, বরং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রও এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বর্তমান সময়ে যুদ্ধে ইউক্রেন অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া ভালো অবস্থানে রয়েছে। জেলেনস্কি ইউক্রেন যুদ্ধ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে চাইছেন। কিন্তু শান্তি আলোচনা এবং মস্কোকে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চাইছে তা নিয়ে কিয়েভ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের শঙ্কা হচ্ছে, ইউক্রেনের জন্য কোনো ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ছাড়াই মস্কোর সঙ্গে শান্তি চুক্তি সই এবং মস্কোকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড় দিতে চাইছে। পুতিন মনে করেন, সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্ররা শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ পাবেন। তাই পুতিন দাবি জানিয়ে আসছিলেন, কোনো ধরনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার তার আগ্রহ নেই। শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হলে সেটি হতে হবে স্থায়ী সমাধান।
শান্তি চুক্তির বিষয়ে পুতিনের সঙ্গে অনেক বিষয়ে একমত হওয়ার কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্প বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যেন একটি শান্তি চুক্তি করা যায়। যুদ্ধবিরতি ও একটি শান্তি চুক্তির জন্য আমরা কাজ করছি। পুতিন শান্তি চুক্তিতে যে আগ্রহী ফান্স ও যুক্তরাজ্য সে বিষয়ে তাকে প্রমাণ দেওয়ার আহ্বান জানায়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে রাজি হওয়ায় সাহসিকতার প্রশংসা করেন। যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার জন্য তিনি পুতিনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় শান্তি চুক্তির বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ট্রাম্প। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, পুতিনকে এখন পূর্ণাঙ্গ ও শর্তহীন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে হবে। তবে শান্তি চুক্তির বিষয়ে পুতিনের মধ্যে কোনো আন্তরিকতার লক্ষণ দেখছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেন, ৩০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতির এ পরিকল্পনা ইউক্রেনে শান্তি ফেরানোর পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এখন এটি পুতিনের ওপর নির্ভর করছে। ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ মনে করেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে। রাশিয়ার পদক্ষেপ এখনো স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না বলে কূটনীতিকরা মনে করেন। বিশেষ করে জেদ্দায় বৈঠকের পর ক্রেমলিন অবশ্য বেশ কৌশলী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না বলেই রাশিয়া এমন কৌশলী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি এস পেশকভ বলেছেন, জেদ্দার আলোচনায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ও মস্কো পর্যবেক্ষণ করেছে। ট্রাম্প-পুতিনের প্রথমবার টেলিফোন আলাপে রাশিয়ার ইতোমধ্যে দখল করা ইউক্রেনের ভূমি নিয়ে ফয়সালা, কোনোভাবেই ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদান করতে না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং পূর্ব-মধ্য ইউরোপে ন্যাটোর হম্বিতম্বি কমিয়ে আনার ব্যাপারে জোরালো দাবি তুলেছিলেন পুতিন। ট্রাম্প আভাস দিয়েছেন, এই চুক্তিতে ইউক্রেনকে ছাড় দিতে হবে। এতদিন ইউক্রেন ছাড় দিতে রাজি না থাকলেও দেশটি অনেকটা বাধ্য হয়েই আপোসে রাজি হয়েছে। খালি চোখে এই চুক্তিতে কারও বিজয় হয়নি মনে হলেও রাশিয়া কৌশলগত বিজয় নিশ্চিত করেই চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মতি দেবে। ইউক্রেনের সঙ্গে ট্রাম্প একটি অর্থনৈতিক চুক্তিও করতে চাচ্ছেন, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী নিরাপত্তার বিষয়টি থাকে। যদিও ইউক্রেন তাদের পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাম্প্রতিক আলোচনায় ২০২২ সালে ইস্তানবুলে যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচিত একটি খসড়া চুক্তিকে শান্তি আলোচনার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করার প্রসঙ্গটিও এসেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সেটি কার্যকর হয়নি। উক্ত আলোচনায় ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পরিত্যাগ ও পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের স্থায়ী প্রতিশ্রুতি চেয়েছিল। একই সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধে অন্য দেশগুলোর হস্তক্ষেপের ওপরও নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলা হয়েছিল। স্টিভ উইটকফ এ প্রসঙ্গে বলেন, ইস্তানবুলের আলোচনাগুলো সংগঠিত ও ফলপ্রসূ ছিল এবং এটি শান্তি চুক্তির জন্য একটি দিকনির্দেশনা হতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের ব্যাপক যুদ্ধের মধ্যেও আলোচিত যুদ্ধবিরতি আগামী সপ্তাহগুলোর মধ্যেই চূড়ান্ত করা সম্ভব বলে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাশা করে। যদিও উভয় রাষ্ট্রই এখনো আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। জেলেনস্কি জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে রুশ বাহিনী ১,৫৮০টিরও বেশি নিয়ন্ত্রিত বোমা, প্রায় ১,১০০টি আক্রমণাত্মক ড্রোন এবং ১৫টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। তিনি বলেন, আমাদের নতুন সমাধান দরকার। মস্কোর ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে তারা এসব হামলা ও যুদ্ধ বন্ধ করে। আলোচনার আগে শান্তি চুক্তির বিষয়ে রাশিয়া যে আগ্রহী নয় তার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। তবে আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাচ্ছে। ট্রাম্প বলেন, আমরা খুব শীঘ্রই পূর্ণ যুদ্ধবিরতি পাব। তিনি দাবি করেন, পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে জ¦ালানি স্থাপনায় হামলা সীমিত করার বিষয়ে একটি সমঝোতা হয়েছে। ক্রেমলিন বলছে, ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে তখনই বৈঠক হবে, যখন একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তি চুক্তি হবে। শান্তি চুক্তির বিষয়ে রাশিয়া কিন্তু খুব একটা তাড়াহুড়া করছে না। কারণ যুদ্ধে দেশটি কিন্তু ভালো অবস্থানে রয়েছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করলে চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক টিকে রাখা কঠিন হতে পারে। রাশিয়া গত দুই দশক ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের নিকট দাবি জানিয়ে আসছে যে, পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতি সীমিত করতে হবে এবং ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক বর্তমানে যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর উভয় রাষ্ট্র মিলেমিশে কাজ করবে। এ প্রসঙ্গে উইটকফ বলেন, এমন একটি বিশ^ কে না চায়, যেখানে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে মিলে ভালো ভালো কাজ করবে, আর্কটিকে নিজেদের জ¦ালানিনীতিতে কিভাবে সমন্বয় আনা যায় সে বিষয়ে চিন্তা করবে, সম্ভব হলে জলপথ ভাগাভাগি করবে, একই সঙ্গে ইউরোপে এলএনজি গ্যাস পাঠাবে, আর হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়েও সহযোগিতা করবে। ট্রাম্প-পুতিনের মধ্যকার সম্পর্কের বর্তমান উষ্ণতায় বোঝা যাচ্ছে, যুদ্ধবিরতির যে আলোচনা চলছে তা রাশিয়া মেনে নিতেই পারে। তবে ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন কি না, সে বিষয়ে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ যথেষ্ট সন্দেহ পোষণ করছেন। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন শান্তিরক্ষী বাহিনী গঠনের চেষ্টা করলে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার কারণে তা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনে নতুন করে যুদ্ধবিরতি হলে তা পর্যবেক্ষণের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কেউ দায়িত্ব পেতে পারে। অবশ্য সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে রাশিয়ার সম্মতি থাকতে হবে। রাশিয়া যত বেশি সুবিধা আদায় করতে পারে ততই লাভবান হবে। তবে তারা শান্তি আলোচনা একেবারে বানচালও করতে চায় না। খুব সম্ভবত ধাপে ধাপে ছোট ছোট চুক্তি হতে পারে, যা একটি বড় চুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো অ্যাঞ্জেলা স্টেন্ট মনে করেন, রাশিয়া কোনো ছাড় দিতে প্রস্তুত বলে মনে হয় না। তাদের দাবি রয়ে গেছে আগের মতোই। তারা সত্যিই কোনো অর্থবহ যুদ্ধবিরতি বা শান্তি চায় কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। একটি দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর শান্তি চুক্তি তখনই সম্ভব হবে যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষ হামলা চালিয়ে বা উসকানি দিয়ে যুদ্ধবিরতির চুক্তি লঙ্ঘনের চেষ্টা না করে। শান্তিতে পৌঁছানোর আগে অনেক বাধা আসবে। তবে সেই বাধা সামাল দিতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়