
পারিপার্শ্বিক কিছু ঘটনায় চোখে জল আসে। বুক ধড়ফড় করে। এক অসহ্য কষ্টে মন ভারী হয়ে ওঠে। এমন অনেকেরই হয়। ঈদে নিজের জন্য কেনা হয় না কিছুই। স্বজনদের জন্য কিছু নিতে রাজধানীর এক মার্কেটে গেলাম, কিন্তু কেনাকাটার বদলে এক অদ্ভুত বেদনা নিয়ে ফিরে এলাম। মার্কেটের কোলাহলের মাঝে হঠাৎ করেই এক করুণ চিৎকার কানে এলোÑ ছোট্ট মেয়ে শিশু, বয়স বড়জোর পাঁচ কি ছয়। চিৎকার করে কাঁদছে। জামাটা সে নেবেই নেবে। বাবার সাধ্য নেই কি করে কিনবে ওই জামা। চেহারা দেখেই বেশ বুঝতে পারলাম। দূর থেকে তাকিয়ে মনে হলো, কী হবে এই মেয়েটার ঈদ? কী হবে এই বাবার অনুভূতির, যখন নিজের বুকের মানিকের চোখের জল মুছিয়ে দিতে পারছেন না? ইচ্ছে হলো এগিয়ে যাই, শুধু ওই একটা নয়, আরও কয়েকটা জামা কিনে তুলে দিই শিশুটির হাতে। যদি ওর মুখে এক চিলতে হাসি ফোটে। ঠিক তখনই থমকে গেলাম। বাবার আত্মসম্মানবোধ কী আমার এই সহানুভূতি মেনে নেবে? যদি অপমানবোধে কষ্ট পান? মানুষের তো আত্মসম্মান আছে। সেদিন চাপা কষ্টে দোকান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ভাবলাম দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অল্প আয়ের মানুষের ঈদ আনন্দটা যেন নিরানন্দ হয়েই আসে। প্রতিটি বাবা-মাই সন্তানদের হাতে ইচ্ছামতো জামাকাপড় তুলে দিয়ে হাসি মুখ দেখতে চায়। কজনের ভাগ্যেই বা সেই হাসি জোটে।
এক বোতল আখের রস, অমূল্য সুখ। সেদিন ইফতারে ছোট ছেলেটা আখের রস খাবে বলতেই বাসা থেকে নিচে নেমে গেলাম। রোদের তাপ তখনো মিলিয়ে যায়নি, কিন্তু সন্তানের ইচ্ছা বলে কথা। জুসবারে দাঁড়িয়ে রস কিনছি, হঠাৎ টেনেটুনে পুরনো একটা ফ্রক পরা এক শিশু এসে দাঁড়াল সামনে। বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে আখের রসের বোতলের দিকে। পকেট থেকে ২০ টাকা হাতে দিলাম, তবু দাঁড়িয়ে রইল। আখের রসের কি তৃপ্তিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। শিশুটির চোখের ভাষা পড়তে কষ্ট হলো না। হাতে ধরা বোতলটা এগিয়ে দিতেই এক নিমেষে তার মুখজুড়ে ফুটে উঠল এক অভাবনীয় হাসিÑযেন চাঁদের আলো গড়িয়ে পড়ল গোধূলির আকাশে। এমন হাসির দাম কি কোনো টাকায় মেলে? রসের বোতলটা নিয়ে সে আনন্দে দৌড় দিল। কৌতূহল জাগল মনে, পিছু নিলাম। গিয়ে দেখি, পাশের রাস্তায় একটি হুইলচেয়ারে বসা পঙ্গু বাবা, পাশে ছোট ভাইটা দাঁড়িয়ে আছে। শিশু মেয়েটা ছুটে গিয়ে বোতলটা তুলে দিল বাবার হাতে। ছোট ভাইটা বোতলটা দেখে ফোকলা দাঁতে এমন এক তৃপ্তির হাসি দিল-যা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। পঙ্গু বাবা, ছোট ভাই আর ছোট্ট মেয়েটার চোখে যে সুখের ঝিলিক দেখলাম, তাতে বুঝলামÑ সে শুধু নিজের জন্য রস কিনতে চায়নি, সুখটুকু ভাগ করে নিতেই ছুটে গিয়েছিল। মাত্র কয়েক টাকার বিনিময়ে সেদিন এক অমূল্য দৃশ্যের সাক্ষী হলাম। সত্যিই, যাদের সামর্থ্য আছে, তারা চাইলেই এমন ছোট ছোট মুহূর্ত দিয়ে পৃথিবীকে একটু উজ্জ্বল করে তুলতে পারেন। সেদিন জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে বড় বোনকে দেখব বলে মিরপুরে যাচ্ছিলাম। ট্রাফিক সিগন্যালে পা নেই লাঠি ভর করেই গাড়ির সামনে হাজির ২২/২৩ বছরের এক যুবক। কিছু টাকা হাতে দিতে চেহারাটা যেন জলজল করছে তার। প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তিটা হয়তো বেশি ছিল, নয়তো তৃপ্তিটা বেশি। ভাবলাম মানুষকে খুশি করতে অনেক বেশি কিছু লাগে না, শুধু একটা মন লাগে। মাঝে মাঝেই যদি এমনটা করি আমরা, অন্তত জ্বলজ্বলে হাসিমুখগুলোতো দেখতে পাব।
খুব নিকটাত্মীয়ের গল্পটা এখন বলছি। সেটি ছিল বছর পনেরো আগের কথা। তখন রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে থাকি আমরা। এক আত্মীয় বিদেশ থেকে সন্তানদের জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় কিনে আনেন। কোরবানি ঈদের ঠিক দু’দিন আগের কথা। সন্তানদের মাঝে কাপড় বণ্টন করছেন। বাসার কাজের বুয়াটা সেদিন তার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে কাজে আসেন। শিশুটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল সেই কাপড়ের দিকে। আত্মীয়ের দিলে ভীষণ চোট লাগে। সঙ্গে সঙ্গেই নিচে নেমে গেলেন তিনি। ফুটপাত থেকে একটি লাল গেঞ্জি আর কালো রঙের প্যান্ট নিয়ে এলেন। তার হাতে কাপড়গুলো দিতেই সে কি আনন্দ। এখনো উপভোগ করি তার সেদিনের জ্বলজ্বলে সেই মুখখানি। অল্পতে খুশি হওয়া সেই চেহারাটা এখনো চোখে ভাসে। বিদেশ থেকে দামি ব্র্যান্ডের কাপড় তার সন্তানদের পছন্দ হয়নি, এটা সেদিন বুঝতে পেরেছি।
জীবনের সুখগুলো এমনই। এমন নানা ভালো কাজের শেষে তৃপ্তির ঘুমও আসে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ঘুমটা আসলে আল্লাহর বিশাল একটা নেয়ামত। লাখ টাকার পালঙ্কে শুয়ে কারও হয়তো ঘুম হয় না। ছটফট করে রাতটা কষ্টে কাটে। রাস্তা কিংবা ফুটপাতে টাঙ্গানো পলিথিনের ভেতরে অনেক দম্পতির কতই না সুখের সংসার। আমরাই দেখি ফুটপাতে শব্দ আর ধুলাবালির মধ্যে কেউ কেউ নাক ডেকে ঘুমায়। আবার দেখি রাস্তার পাশে কোনো খালি জায়গায় ভর রোদে তৃপ্তির ঘুম দিচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। অনেকে এসিতে ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুমাতে পারেন না। দামি গাড়ি, বাড়ি, খাট-পালং আর অর্থ বৈভব দিয়ে সুখ আর তৃপ্তি পাওয়া যায় না। সুখটা অন্য এক রকম। অনেক অর্থের মধ্যে থেকেও মানুষ সুখী নয়। আবার অল্প অর্থে খুব সুন্দর সুখী জীবনযাপন করছেন অনেকে।
সুখী হতে নিজেকে সুখী ভাবতে হয়। সুখ পেতে হয় নিজের কাছেই। অঢেল অর্থের মালিক এক পুলিশ কর্মকর্তা তার মাকে অসুস্থ হলে প্রথমে চেন্নাই পরে সিঙ্গাপুর পাঠান চিকিৎসার জন্য। মাস দুয়েক পরে খালাম্মাকে লাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে দেশে। কোনো চিকিৎসক কোনো চিকিৎসায় তাকে সারিয়ে তুলতে পারেননি। একই সময় আমাদের কাজের ছেলাটা তার মার অসুস্থতার কথা জানায় আমাদের। বলছিল, মস্ত বড় রোগ হয়েছে তার। বাঁচানো যাবে না নাকি। আমার ডাক্তার ছেলেটা তার হাসপাতালে ক’দিন চিকিৎসা দিতেই তিনি ভালো হয়ে উঠলেন। মাত্র অল্প কিছু টাকা খরচেই সুস্থ হলেন ওই মা। সুস্থতা আল্লাহর বড় নেয়ামত। কেউ অল্পতেই সেরে ওঠেন আবার সুস্থ মানুষ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যান। শত চেষ্টায়ও তাকে আর এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। এমনটাই হচ্ছে সব সময়।
আমাদের ঈদ আনন্দ কখনো শুধু আমাদের পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বাবা-মা সবসময় চেষ্টা করতেন আশপাশের অভাবী মানুষদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে। আমাদের ঘর ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। চেনা-অচেনা অনেকেই আসতেন। সবাইকে স্নেহ-ভালোবাসায় আপন করে নিতেন তারা। নতুন জামা, মিষ্টি, ঈদের উপহার। এসব শুধু আমাদের জন্য নয়, যারা হয়তো স্বপ্নেও এসব কল্পনা করতে পারেনি, তাদের জন্যও ছিল সমানভাবে বরাদ্দ। বাবা-মা বিশ্বাস করতেন, ঈদের প্রকৃত আনন্দ তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। বাবাকে সবসময়ই দেখেছি ন্যায়-নীতির এক অবিচল পথিক হিসেবে। তার কাছে সত্য ছিল অমোঘ, ন্যায়বিচার ছিল জীবনের মূলমন্ত্র। পারিবারিক বা সামাজিক যে কোনো বিষয়ে তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ এক বিচারক। যেখানে আবেগ নয়, ন্যায়ই ছিল তার একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। বাবা-মা শুধু আমাদের শাসক ছিলেন না, ছিলেন পথপ্রদর্শকও। তারা শিখিয়েছেন, বড় হওয়া মানে শুধু বিত্তবান হওয়া নয়, বড় হওয়া মানে মানবিক হওয়া, উদার হওয়া, অন্যের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা। জীবনের আনন্দ ও সুখ আমাদের আশপাশেই ছড়িয়ে আছে। শুধু খুঁজে নেওয়ার দৃষ্টিটা থাকতে হয়। অল্পতে সুখী হওয়ার আর সবাইকে নিয়ে সুখী হওয়ার অভ্যাসটাই পারে জীবনকে সুন্দর ও পরিপূর্ণ করে তুলতে। আসুন, আমরা সবাইকে নিয়ে ঈদ আনন্দ উপভোগ করি।
লেখক : সাংবাদিক
www.mirabdulalim.com