ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩১ মার্চ ২০২৫, ১৭ চৈত্র ১৪৩১

জমে উঠছে ঈদের বাজার

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ২৭ মার্চ ২০২৫

জমে উঠছে ঈদের বাজার

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর এগিয়ে আসছে। প্রতি বছর এ আনন্দে সব পরিবারেই থাকে বাড়তি কেনাকাটার চাপ। রমজানজুড়ে সেহরি ও ইফতার বাবদও অতিরিক্ত ব্যয় হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে এবার রোজায় ভোগব্যয়সহ ঈদকেন্দ্রিক বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটায় সারাদেশে মার্কেট ও বিপণিবিতানগুলোর ২৫ লাখ দোকানে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা বাণিজ্যের প্রত্যাশা করছেন ব্যবসায়ীরা। আবার ঈদকে কেন্দ্র করে পবিত্র রমজান মাসের প্রথম ১৫ দিনে ২০ হাজার ২৫২ কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছে। ফলে রেমিটেন্সে অর্থনীতি চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। রেমিটেন্স ও শহরের মানুষ গ্রামমুখী হওয়ায় গ্রামীণ হাট-বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, গতিশীল অভ্যন্তরীণ বাজারব্যবস্থার সঙ্গে জাকাত ও ফিতরা যোগ হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, ঈদে গ্রামীণ অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বেড়েছে। ফলে সচল হয়ে ওঠে গ্রামীণ অর্থনীতি। ঈদের সময় আর্থিক মানদণ্ডে অর্থনীতিতে কত টাকা প্রবাহিত হয়, তা নিয়ে সরকারিভাবে কোনো তথ্য নেই। তবে বেসরকারি গবেষণা অনুযায়ী ঈদ উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে দেড় লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত লেনদেন হয়। এ টাকার বড় অংশই যায় গ্রামে। এ সময় নিম্ন আয়ের মানুষের হাতেও টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। এ সময় তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সেক্ষেত্রে বাড়তি টাকা প্রবাহের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা হয়। ফলে ঈদ অর্থনীতির আকারও বড় হচ্ছে। তবে মানুষের আয়ের বেশিরভাগ খরচ হয়ে যায় দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে। সে কারণে ঈদে বিক্রি বাড়লেও তার হার গতবারের তুলনায় কম। উচ্চ মূল্যস্ফীতিই এর অন্যতম কারণ। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি পরিচালিত সমীক্ষা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঈদকে কেন্দ্র করে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়ে আসছে। তবে এ বছর মূল্যস্ফীতির কারণে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম অতিরিক্ত ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণে আগের বছরগুলোর তুলনায় এবার কেনাকাটা কিছু কম হচ্ছে।
ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে সব শ্রেণির মানুষের কেনাকাটার চাপও তত বাড়ছে। ফুটপাত থেকে অভিজাতÑ সব ধরনের মার্কেটে থাকে উপচে পড়া ভিড়। কেনাকাটায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে নতুন পোশাক। এছাড়া গহনাসামগ্রী, কসমেটিকস থেকে চুড়ি-ফিতা সবই কেনা চাই। বিভিন্ন খাবারও ঈদের কেনাকাটায় গুরুত্ব পায়। পোশাকের দোকানগুলোতে পুরুষদের পায়জামা-পাঞ্জাবি, শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি, টি-শার্ট এবং নারীদের শাড়ি, থ্রি-পিস, ওয়ান পিস, কুর্তা এবং শিশুদের পায়জামা-পাঞ্জাবি, গেঞ্জিসেটসহ আধুনিক ডিজাইনের পোশাক পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে কসমেটিকস, জুতা, ঘর সাজানোর সামগ্রী এবং গহনার দোকানগুলোতে ভিড় জমাচ্ছেন মানুষজন। এ ছাড়া সিল্ক, জামদানি, কাতান, কাশ্মীরী কাজ করা শাড়ি, সুতি শাড়ি ও লেহেঙ্গা, পুরুষদের পায়জামা-পাঞ্জাবি, টি-শার্ট এবং শিশুদের জন্য নানা রঙের আরামদায়ক পোশাকের চাহিদা বেশি। গরমকে প্রাধান্য দিয়ে ক্রেতারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুতি কাপড় কিনছেন। নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, নূর ম্যানশন মার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট এবং নূরজাহান ম্যানশনে মহিলা ক্রেতার পরিমাণ বেশি দেখা যায়। চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট ও ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট, নুরজাহান সুপার মার্কেট এবং গ্লোব শপিং সেন্টারের শার্ট-প্যান্টের দোকানগুলোতে ভিড় বেশি তরুণ ক্রেতাদের। এ ছাড়া সায়েন্সল্যাবের বাইতুল মামুর জামে মসজিদ মার্কেট, প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারে পাঞ্জাবি-পায়জামার দোকান এবং এলিফেন্ট রোডের জুতার দোকানগুলোতেও ক্রেতাদের ভিড় দেখা গেছে। ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে শাড়ি কিনতে আসা তানিয়া খাতুন বলেন, যেহেতু বাচ্চার স্কুল বন্ধ, সেজন্য শেষ সময়ে ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই গ্রামের বাড়িতে চলে যাব। তাই পরিবারের সদস্যদের জন্য কাপড় কেনাকাটা করছি। ব্যবসায়ীরা দাম কিছুটা বেশিই চাচ্ছেন। দামাদামি করে নিতে হচ্ছে। তা ছাড়া এবার সবাই রোজা রেখে কষ্ট হলেও দিনের বেলাতেই কেনাকাটা শেষ করতে চাচ্ছেন। সেজন্য ভিড়ও একটু বেশি। রাজধানীর বসুন্ধরা শপিংমল, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি, মৌচাক, বেইলি রোড, মিরপুর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিগত বছরগুলোতে রোজার সময় বিকেলে কিংবা ইফতারের পর থেকে মার্কেটগুলোতে কেনাকাটার জন্য মানুষজনের উপস্থিতি দেখা গেলেও এ বছর সকাল থেকেই মানুষ মার্কেটে ভিড় করছেন। এতে করে আগেভাগেই ঈদের বাজারে তৈরি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। ঈদ উপলক্ষে শপিংমলগুলোতে দেওয়া হয়েছে নানা ধরনের অফার।
ফুটপাতের বিক্রেতারা বলছেন, ফুটপাতে দোকান ভাড়া না থাকায় কম দামে পণ্য বিক্রি করতে পারেন তারা। অপেক্ষাকৃত কম দামে পণ্য পেয়ে ফুটপাতের মার্কেটে ভিড় করছেন অনেক ক্রেতা। ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে মিরপুরের বিভিন্ন মার্কেটেও। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নাজমা আক্তার বলেন, মেয়েদের একটু আগেভাগেই কেনাকাটা করতে হয়। কারণ, পোশাকগুলো আবার দিতে হয় সেলাই করতে। তাই আগেই এসেছেন ঈদের কেনাকাটা করতে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতদিন ক্রেতাদের তেমন একটা ভিড় দেখা যায়নি। ঈদে ক্রেতাদের চাপ ১৪ রমজানের পর থেকে বেশি হয়। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় ক্রেতাদের উপস্থিতি হয় বেশি। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার আড়ংয়ের বিক্রয়কর্মী রাফিউল হাসান বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার আগে থেকেই কেনাকাটার জন্য মানুষের ভিড় দেখতে পাচ্ছি। সকালে আউটলেট খোলার পর থেকে প্রচুর লোকসমাগম হচ্ছে। দুপুরের পর থেকে সেটি আরও বেড়ে যাচ্ছে। পাঞ্জাবি, শাড়ি, ওয়ান পিস ও বাচ্চাদের পোশাকের পাশাপাশি বিভিন্ন কসমেটিকস আইটেম, গহনা, লেডিস ব্যাগ-পার্টস অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে অনলাইনেও ঈদের পোশাক বিক্রি হচ্ছে। যেসব বড় প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট ক্রেতাগোষ্ঠী রয়েছে, তারাই অনলাইনে ভালো বিক্রি করতে পারছে। অন্যরা ফেসবুকে বিক্রির চেষ্টা করছে।
পবিত্র রমজান মাসের জন্য সরকারের কৃষি পণ্য/খাদ্য সরবরাহে বিশেষ আয়োজনের ব্যবস্থা করে থাকে বিশেষত মধ্যবিত্ত/দরিদ্র্য শ্রেণির কথা বিবেচনায় রেখে। যেমনÑ রমজানের আগে থেকেই সরকার টিসিবির কার্যক্রম কিছুটা বাড়িয়েছে, সুনির্দিষ্ট কিছু জায়গায় ট্রাকে করে নিত্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে এবং এসব পণ্য কিনতে ট্রাকের পেছনে লোকজনের দীর্ঘ সারিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা থেকে অনুমেয় নিম্ন আয়ের মানুষগুলো আসলে কষ্টে আছে। দামজনিত বহিস্থ অভিঘাত মোকাবিলার আরেকটি উপায় হলো কর-শুল্ক কাঠামোর সমন্বয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, চিনি থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল জাত খাদ্য ও কৃষি খাতের সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বমুখী মূল্য মানেই এসব পণ্য বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে বাংলাদেশকেও। মানুষের জীবনধারণ, কৃষি, অবকাঠামো, শিল্পসহ পুরো অর্থনীতিতে এর প্রভাব অনেক। আমদানি শুল্ক কমানো হলে খরচ কম পড়বে এবং স্থানীয় বাজারেও দাম কম রাখা যায়।
উৎসবকেন্দ্রিক কেনাকাটার ব্যাপারটি যেন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। দিনে দিনে আর্থিক সক্ষমতা, ক্রয়সামর্থ্য বেড়ে যাওয়ায় উৎসবকে কেন্দ্র করে বাজারের সম্প্রসারণ ঘটেছে। তবে এ বছর রমজান ও বসন্ত অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব ধরে রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। উৎসব খুব কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠিত হওয়ায় তথা বসন্তের প্রভাব ফিরে এসেছে উৎসবকেন্দ্রিক বাজারেও। বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট উৎপাদনকারী, পণ্যসামগ্রী সরবরাহকারী, প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচাঞ্চল্য বেড়ে গেছে বহুগুণ। জামাকাপড় পোশাক, শাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, কারখানা তাঁতী, বুননশিল্পী সবার মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বিরাজ করছে। ফলে গোটা অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে নবজাগরণ।
ঈদ উপলক্ষে সেবা খাতগুলো রমরমা ব্যবসায় ব্যস্ত রয়েছে। যেমনÑ হোটেল-রোস্তরাঁ, যানবাহন, সিনেমা হল, মিষ্টির দোকান। সর্বোপরি পর্যটন শিল্প। ঐতিহ্যগতভাবে ঈদের ছুটিতে মানুষ শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে শহরে ছুটে যায়। এই সময়ে বেশ লম্বা ছুটি পাওয়া যায়, তাই তারা পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। ভ্রমণপিপাসু মানুষদের শৈবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, রামুর বৌদ্ধ মন্দির, হিমছড়ির ঝরনা, ইনানী সমুদ্রসৈকত, বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, টাঙ্গুয়ার হাওড়, টেকনাফ সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ি অঞ্চল দেখে কেউ কেউ আত্মভোলা হয়ে যায়। আবার দেশে অনেক ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানও রয়েছে। যেমনÑ বগুড়ার মহাস্থানগড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর মাজার, রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর, কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের মাজার, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি শুধু দেশীয় নয়, বরং বিদেশী পর্যটক ও দর্শনার্থীদের নিকটও সমানভাবে জনপ্রিয়। সার্বিকভাবে বলা যায়, ঈদ অর্থনীতি বাংলাদেশের জিডিপিতে একটি বড় অবদান রাখছে।
ঈদ উৎসব হোক সর্বজনীন ও আনন্দ মুখর। ঈদ বারবার আসুক আমাদের জীবনে আনন্দের বার্তা নিয়ে।

লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ, গবেষক, সাবেক ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্নিটি, ঢাকা

×