
আজ পবিত্র জুমাতুল বিদা। ক’দিন পরই রোজা শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এদিনগুলোতে ঈদ শপিং মানসিকতার মানুষের যেমন ব্যস্ততার শেষ নেই তেমনি মাহে রমজানকে সদব্যবহারকারীদের উদ্বিগ্নতারও শেষ নেই। কারণ রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের প্রতিশ্রুত মাসটি ক্রমেই বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। তাই আজ জুমাতুল বিদা আদায়ের ব্যস্ততা। এমনিতেই জুমার দিনের ফজিলত অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে বেশিÑ একথা বলাই বাহুল্য। মাহে রমজানের সর্বশেষ জুমা অর্থাৎ জুমাতুল বিদা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হৃদয়ে দাগ কাটে বেশি। কারণ এদিন মসজিদে মসজিদে ইমাম খতিবগণ হৃদয়গ্রাহী সুরে মাহে রমজানকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানান। মুসলমানদের বিশ্বাস মাহে রমজানের এ একটি জুমা অন্য মাসে ৭০টি জুমার সমতুল্য মর্যাদাবান।
প্রসঙ্গত জুমাতুল বিদা পরিভাষাটি আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে একটি নতুন আকর্ষণীয় অভিধা। ইসলামের প্রাচীন গ্রন্থসমূহে এ পরিভাষা নেই। এমনকি কুরআন হাদিসেও জুমাতুল বিদা শব্দটির উল্লেখ নেই। তবে বর্তমানে আমজনতার কাছে বেশ হৃদয়গ্রাহী অনুষ্ঠান ও প্রিয় শব্দ এটি। প্রত্যেক ধর্মে বিশেষ একটি দিন থাকে। যেমনÑ ইহুদি ধর্মে শনিবার, খ্রিস্টানধর্মে রবিবার। মুসলমানদের কাছে সপ্তাহের অতি পবিত্র দিন জুমাবার। কুরআন এবং হাদিসে এর আলোচনা ব্যাপক। জুমাতুল বিদা দিবসটি আরও মহিমান্বিত হয়েছে কারণ দিবসটিকে বায়তুল মুকাদ্দাস রক্ষার স্মরণে কুদুস দিবস হিসেবেও বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়। তাই জুমাতুল বিদা আমাদের পবিত্রতম কিবলা ও স্থান বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের শপথ নেওয়ারও দিবস। বায়তুল মুকাদ্দাসে নামাজ আদায়ে এক রাকাতে ৫০ হাজার রাকাতের সাওয়াব। এখানে রয়েছে হাজার হাজার নবীর জন্মস্থান ও ওফাতস্থল। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) ৬১৯ খ্রিস্টাব্দে মি’রাজ শরিফে যাওয়ার সময় এখানে যাত্রাবিরতি করেছিলেন এবং তামাম নবী রাসুলদের (আ.) এ বিশাল জামাতে ইমামতি করেছিলেন। এ পবিত্র মসজিদ আজ ইহুদি নাসারাদের করতলগত। এখানে মুসলমানদের নামাজ আদায় ও নিরাপদ বসবাসের একান্ত দাবি। এ দাবি বাস্তবায়নের জন্য আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা সোচ্চার। জুমাতুল বিদায় এ সোচ্চার কণ্ঠ আরও একীভূত হয়। তাই এ দিন আমরা জুমাতুল বিদার বিশেষ মুনাজাতে অংশগ্রহণ করব আমাদের দুনিয়ার সম্মান ও আখিরাতের নাজাতের জন্য আর নফল ইবাদাত তাওবা ও ইস্তিগফারে কাটাব।
সম্মানিত মুমিন মুসলমান ভাইয়েরা! ইহতিসাব ইস্তিগফার ও তাওবা অনুশোচনা বিমিশ্রিত নফল ইবাদাতের মূল্য অনেক বেশি। বলতে গেলে, মাহে রমজানের সমাপনী দশক পুরোটাই তাওবা ও ইহতিসাবের। একটি সত্য ঘটনা বলি। বনি ইসরাঈলের এক ব্যক্তি ৯৯ জন লোককে হত্যা করেছিল। তারপর সে তওবার উদ্দেশ্যে বের হয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল যে, কিসে গোনাহ্ মাফ হতে পারে? অবশেষে সে একজন পাদ্রির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল যে, তার গোনাহ্র কি কোন তওবা আছে? পাদ্রি বলল, না। সে তখন সেই পাদ্রিকেও হত্যা করল। সে বরাবর লোকজনের কাছে এই একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে পথ চলতে লাগল। তখন এক ব্যক্তি বলল, তুমি অমুক গ্রামে যাও (সেখানে তোমার তওবা হতে পারে)। ঐ ব্যক্তি অতি আগ্রহ ও পরিশ্রমের সঙ্গে সেদিকে যেতে লাগল। পথিমধ্যে মওত তাকে আক্রমণ করল (মারা গেল)। তখন রহমতের ফেরেশতা ও আজাবের ফেরেশতা পরস্পর বাদানুবাদ আরম্ভ করে। আল্লাহ তায়ালা তাদের কাছে অহী পাঠালেনÑ ব্যক্তিটি যে গ্রামে তওবার জন্য যাচ্ছিল সেটা দূরে নাকি যেখান থেকে রওনা হয়েছিল সেটা দূরে? তোমরা উভয় দিকটা পরিমাপ কর। অতঃপর সে ব্যক্তি যে গ্রামের দিকে যাচ্ছিল, ফেরেশতারগণ পরিমাপ করে দেখল সেটা সামান্য নিকটতর। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে মাফ করে দিলেন।
এ ছাড়া আমাদের আজ আরও স্মরণ রাখতে হবে, আল্লাহ পাক বছরের বিভিন্ন সময়ে বরকতের মাস ও বরকতের রাত দিয়ে সাধারণ মানুষকে অনুশোচনা, আত্মোপলব্ধি ও আত্মগঠনের সুযোগ করে দেন। সুযোগ করে দেন ক্ষমা ও মার্জনার পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পর্ক গভীর করতে। বছরের পাঁচটি রাতকে ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। তম্মধ্যে একটি রজবের পহেলা তারিখের রাত, দ্বিতীয়টি শবে বরাত, তৃতীয়টি শবে কদর, চতুর্থটি ঈদুল ফিতরের পূর্বরাত এবং পঞ্চমটি হলো ঈদুল আজহার (পূর্ব) রাত।
রমজানের বিদায়লগ্নে আমাদের ঈদুল ফিতরের আগের রাতকে মর্যাদা সহকারে অতিবাহিত করার কৃতসংকল্প হতে হবে। কারণ এ মহান রজনীও ইবাদতের, ক্ষমা ও মার্জনার। সেকালের নেককার মুসলমানরা তাই শবে কদরের মতো ঈদপূর্ব রাতকে ইবাদত বন্দেগি ও রাত্রি জাগরণের মাধ্যম অতিবাহিত করতেন। আজকের যুগের মানুষরা তা আনন্দ, ব্যস্ততা ও কেনা কাটায় দিশেহারা হয়ে ভুলে বসে। এখানেই মুসলমানিত্বের মধ্যে ফারাক ও তফাৎ। অথচ আমাদের প্রিয় নবী হুজুর পূর নূর (স.) ইরশাদ করেছেনÑ যে ব্যক্তি সাওয়াবের নিয়তে দুই ঈদের রাতে জেগে ইবাদত করবেÑ যেদিন সকলের অন্তর মরে যাবে সেদিন তার অন্তর মরবে না।
মাহে রমজান শেষে ঈদের আনন্দ মুহূর্তে ফিতরা দান একটি অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত ও দায়িত্ব। রোজা ও নামাজ মুসলমানদের দৈহিক ইবাদতের অন্তর্গত। হজ হলো দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত। আর জাকাত, ফিৎরা দান হলো আর্থিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। রমজানের পূর্ণতা ও সিয়াম সাধনায় তাওফিক দানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আল্লাহর নামে সাদকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। এ মাসের ইবাদত বন্দেগিতে আমাদের অনিচ্ছাকৃত যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ শরিয়তে ফিতরা ওয়াজিব হয়েছে।
আসলে রমজানের শুরুতে এবং শেষ পর্যায়ে সামর্থবানদের উচিত দান-সদকা, যাকাত ফিতরা দানে অত্যধিক উদার ও রহমদিল হওয়া। এ সময় ধনীদের হাতে বিভিন্ন খাত হতে পয়সা আসে। পক্ষান্তরে অভাবীদের অভাবের মাত্রা বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতেই ধনিক শ্রেণীর উচিত গরিব আত্মীয় স্বজন ও পড়শীদের খোঁজ খবর নেওয়া এবং নিকট অতীতে যেসব পরিবারে কোন আপনজন হারিয়েছে তাদের সহমর্মিতা জানানো, ঈদের আনন্দে তাদের খোঁজখবর নেওয়া। মাহে রমজানে মসজিদগুলো আবাদ হয়। মুসল্লি সমাগম হয় প্রচুর। আমরা সকলে এ মৌসুমে মসজিদ ও মসজিদের পরিবেশের উন্নয়নকল্পে আর্থিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাহায্যের হাত বাড়াতে পারি।
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর এখন পবিত্র ঈদুল ফিতর অত্যাসন্ন। ঈদুল ফিতর মানে রোজা ভাঙার উৎসব। গত একমাস ধরে সিয়াম সাধনার মধ্যে দিয়ে রোজাদার যে কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে, আজ তা থেকে উত্তীর্ণের সময় ক্রমেই ঘনিয়ে এসেছে। চতুর্দিকে তাই আজ ঈদের আমেজ সুস্পষ্ট। মুসলিম সমাজ জীবনে ঈদুল ফিতরের অবারিত আনন্দধারার তুলনা চলেনা। কারণ প্রথমত এ আনন্দ-উৎসবের আমেজ গরিবের পণ্য কুটির হতে ধনীর বালাখানা পর্যন্ত সমানভাবে মুখরিত। শহর নগর গ্রাম গঞ্জ সর্বত্র এর ঢেউ বি¯ৃÍত। দ্বিতীয়ত এ আনন্দ অতি পবিত্র ও নির্মল। এখানে বাড়াবাড়ি নেই, অতিরঞ্জিতের কোনো স্থান নেই। আছে আত্মত্যাগ, অন্যকে কাছে টানার ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের সমন্বিত কর্মসূচি। বস্তুত এ ঈদ নেককারদের, প্রকৃত সিয়াম সাধকদের ঈদুন লিল আবরার; তাদের জন্য ঈদ নয় যারা নতুন পোশাকের বাহাদুরির জন্য উম্মত্ত, তাদের জন্য ঈদÑ যারা পবিত্র জীবন গড়ার প্রত্যয়ে উদগ্রীব।
লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব।
[email protected]