
সাধারণ অর্থে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা মুসলিম সমাজে আনন্দ, সম্প্রীতি ও সমতার বার্তা নিয়ে আসে। মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ায়, দান-সদকার মাধ্যমে দরিদ্রদের সহায়তা এবং পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার সুযোগ এনে দেয়। পাশাপাশি অর্থনীতিতে ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি, বাজারে কেনাকাটার চাঙ্গাভাব, ব্যবসায়িক লাভ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করে। বাংলাদেশে দেখা না গেলেও বিশে^র অনেক মুসলিম-অধ্যুষিত সমাজ ও রাষ্ট্রে ঈদের দেখা-সাক্ষাৎ-মিলনের সুযোগে চরম রাজনৈতিক বৈরিতাও দূর হতে দেখা যায়। তবু এবারের ঈদ বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ভিন্ন রকম এক আনন্দ ও বেদনার অনুভূতি নিয়ে এসেছে। কারণ, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গন দীর্ঘ দেড় দশক পর কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে ধরা দিয়েছে। কতৃত্ববাদী একটি শাসকগোষ্ঠী শত শত তরুণকে হতাহত ও নিধন করার পর ছাত্র-জনতার চাপে সদলবলে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। স্বভাবতই প্রায় ১৮ কোটি বাংলাদেশীর এই রাষ্ট্রটিতে তথাকথিত ‘পরিচালক’ রূপে নতুন শাসক-শোষকের প্রয়োজন পড়েছে। এমন এক দোলাচলের মধ্যেই বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের মানুষের ব্যয় বেশি, তুলনায় আয়-উপার্জন কম। পাশাপাশি কর্মসংস্থান কম, বিনিয়োগে রয়েছে ভাটা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নাজুক। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কিছু কমার লক্ষণ দেখা গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন এখনো দুর্বিষহ। কারণ, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ স্বল্প, সীমিত ও ছকবাঁধা আয়ের মানুষ, মূল্যস্ফীতি যাদের ক্রয়ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে। ফলে শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অনেক কিছুর জন্যই তারা প্রয়োজনমতো খরচ করতে পারছে না। বলা যায়, মুনাফানির্ভর পুঁজিবাদের সেবা ও অন্যের অর্থ-সম্পদ নানাভাবে আত্মসাৎ করে বিত্তশালী হওয়া কিছু মানুষ ও তাদের পোষ্যরা ছাড়া দেশের সবারই কমবেশি আর্থিক অনটনের কথা ভাবতে হচ্ছে। তার ওপর দেশজুড়ে চলছে নানামাত্রিক সংকট ও সমস্যা। সংগতভাবেই বলা যায়, আশা-নিরাশার শক্তিশালী এক আবহের মধ্যেই এসেছে এবারের ঈদুল ফিতর। অন্যভাবে বলা যায়, দেশের মানুষের ঈদকেন্দ্রিক আনন্দ উদ্যাপন-উপভোগের বিশেষ উপলক্ষটিতেও প্রবল আশা ও গভীর হতাশার ছায়া রয়েছে। যেখানে সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির ত্রিমাত্রিক বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। যদিও রাজনৈতিক অর্থনীতি অর্থনীতি শাস্ত্রের অন্যতম শাখা এবং এবারের ঈদে অর্থনীতিতে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় রাজনৈতিক অর্থনীতি বেশি প্রাসঙ্গিক, তবু ঈদের আনন্দে পঙ্কিল রাজনীতির আলোচনা আপাতত দূরেই থাক।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরেছে ঈদ উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস, ব্যবসায়ীদের লেনদেন ও প্রবাসীদের কল্যাণে। পবিত্র রমজানের মার্চ মাসের প্রথম ১৯ দিনে প্রবাসীরা ২২৫ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন (প্রায় ২৭,৪৭৪ কোটি টাকা)। প্রবাসী বাংলাদেশীরা মাতৃভূমিতে তাদের স্বজনদের আনন্দ উদ্যাপন উপলক্ষ করে যে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন, তা পুরো দেশের বাজারে প্রবাহিত হওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের মালিক ও কর্মীরাও শত প্রতিকূলতা নিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রেখে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপসহ বিভিন্ন বাজারে পণ্য পাঠিয়ে রপ্তানি ঈদের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছেন। আমরা অনেকে অনুধাবনই করি না যে, মেহনতি কৃষক-শ্রমিক বিশেষ করে পোশাককর্মী ও প্রবাসীরাই নানামাত্রিক সংকটে জেরবার বাংলাদেশের ২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরের আনন্দ উদ্যাপনের ভগ্নপ্রায় আর্থিক কাঠামোটিকে এখনো ভদ্রস্থ রেখেছেন। আর এই কাঠামোকে দাঁড় করিয়ে রাখছেন, দেশে কর্মক্ষম মোট জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশের প্রতিনিধিত্বকারী অথচ রাষ্ট্রের স্বীকৃতিটুকুও না-পাওয়া অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মী।
প্রতি বছর দুই ঈদে বিপুল পরিমাণ নগদ লেনদেন হয়, যা অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য গতিশীলতা আনে এবং দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তবে ঈদুল ফিতরকে ঘিরে প্রায় সব ধরনের ব্যবসায় চাঙ্গাভাব দেখা যায়। কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতারা আর্থিক চাপে থাকলেও, ঈদ উদযাপনে কোনো কমতি রাখতে চান না। এটাই অর্থনীতিকে গতিশীল করে। এর ফলে ঈদ উপলক্ষে ভালো খাবার, নতুন পোশাক এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির (বিএসওএ) সাম্প্রতিক জরিপ অনুসারে, ঈদুল ফিতরকে ঘিরে দেশে আনুমানিক ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে। এর মধ্যে পোশাক খাতে ব্যয় হয় ৩৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। জামা-কাপড়ের পাশাপাশি টুপি, দুধ, চিনি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক পণ্যের চাহিদাও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। পাশাপাশি উৎসবের মর্মবাণীর সঙ্গে মিল রেখে উপহার-দান ও দাতব্য কার্যক্রমও ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। একটি হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ফিতরা হিসেবে বিতরণ করা হয়, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক কার্যক্রম চালাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া জাকাতসহ অনানুষ্ঠানিকভাবেও আরও বেশি অর্থ দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ঈদের ছুটিতে মানুষ গ্রামে গেলে আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্র প্রতিবেশীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন, যা সম্পদের পুনর্বণ্টনের একটি বড় উৎস। ঈদের সময় বিভিন্ন খাতে অস্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান চুক্তিভিত্তিক অতিরিক্ত বিক্রয় সহকারী নিয়োগ দেয়। ফ্যাশন হাউসগুলোর বার্ষিক মোট বিক্রির অর্ধেকই এই ঈদে হয়ে থাকে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাকের চাহিদা দৈনিক বিক্রি ঈদের মৌসুমে গড়ে তিনগুণ বেড়ে যায়। তবে সুতাসহ কাঁচামালের দাম ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবং কিছু আনুষঙ্গিক পণ্যে ভ্যাট বাড়ানোয় এ বছর পোশাকের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঈদের সময় প্রায় চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে। ফলে পরিবহন খাত অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ঈদে বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও বিমান পরিবহন ব্যবস্থা অতিরিক্ত চাপে পড়ে। এ সময় অনেক মানুষ তাদের বাড়ি সাজানোর জন্য আসবাবপত্র, গহনা এবং অন্যান্য বিলাসপণ্য কেনেন। ফার্নিচার বিক্রি প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ঈদ উপলক্ষে অতিথি আপ্যায়নের জন্য প্রায় ২৭ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। খাদ্যপণ্য ও রান্নার উপকরণের চাহিদাও বৃদ্ধি পায় ব্যাপকভাবে। চিনি ও দুধের চাহিদা দ্বিগুণ হয়, মিষ্টি, টক দই ও মিষ্টি দইয়ের বিক্রি বৃদ্ধি পায়। সুগন্ধি চাল, মুরগি, গরু-খাসির মাংস, তেল ও মসলার চাহিদাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভোগ্যপণ্য বিক্রিও ঈদের আগে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। গত বছর এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছিলেন, যেখানে প্রতি মাসে গড়ে ২০ হাজার টন সয়াবিন তেল বিক্রি হয়, সেখানে ঈদের আগে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার টনে। অলঙ্কারের চাহিদাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এ সময়। ফলে জুয়েলারি দোকানের দৈনিক বিক্রি অন্তত দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তবে স্বর্ণের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি চলতি বছর জুয়েলারির চাহিদা সম্ভবত কিছু কমিয়েছে। তবে যাদের হাতে সঞ্চয় করার মতো যথেষ্ট অর্থ আছে এবং ভূসম্পত্তি কেনায় আইন-আদালতের ভয় আছে, তাদের জন্য এ বছরের ঈদে জুয়েলারিতে বিনিয়োগ আদর্শ উপলক্ষ। এ ছাড়াও ঈদের সময় পর্যটন শিল্পেও ব্যাপক উন্নতি দেখা যায়। যারা গ্রামে না গিয়ে শহরেই থাকেন এবং কিছুটা সচ্ছল, তারা ছুটে যান পর্যটনকেন্দ্রগুলোর দিকে। ফলে হোটেল, রিসোর্ট ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যবসার আয়ে ঈদের সময় লক্ষণীয় প্রবৃদ্ধি হয়। সার্বিকভাবে, ঈদ দেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী প্রভাব ফেলে এবং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
আশা করা হচ্ছে, এবারের ঈদে জাতীয় অর্থনীতিতে সব মিলিয়ে দেড় লাখ কোটি টাকা লেনদেন হতে পারে, যার বড় একটি অংশ গ্রামীণ অর্থনীতিতে যোগ হয়ে কৃষক, দরিদ্র মানুষ, স্থানীয় বাজারসংশ্লিষ্টদের চাঙ্গা করবে। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে আরও গতি আসবে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট মহল ও বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এবারের ঈদকেন্দ্রিক বাণিজ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী বিক্রিতে ইতিবাচক সাড়া পেলেও, অনেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিক্রিতে মন্দা দেখছেন। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতিসহ নানাবিধ কারণে সবকিছুর পেছনে অধিক অর্থ ব্যয় করতে হওয়ায় পোশাক খাতে বিক্রির পরিমাণ কিছুটা কমে যেতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংকিং কার্যক্রমে ঈদ উপলক্ষে টানা ৯ দিনের দীর্ঘ ছুটিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ফলে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক প্রবাহ ও ব্যবসাবাণিজ্যে কিছুটা নেতিবাবচক প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঈদ উপলক্ষে রীতি অনুযায়ী নতুন নোট বিনিময় করার কার্যক্রম এবার স্থগিত করেছে। ফলে এবার ঈদে বাজারে নতুন নোটের প্রচলন কম থাকবে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা বিরক্তি সৃষ্টি করতে পারে। সার্বিকভাবে ঈদুল ফিতর ২০২৫ বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অম্লমধুর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। রেমিটেন্স প্রবাহ, বাড়তি বোনাস ও প্রণোদনা গ্রামীণ অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফেরালেও, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় কিছু খাতে মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে। সবকিছু ছাপিয়ে ঈদুল ফিতর সবার জন্য আনন্দের ছোঁয়া নিয়ে আসুক, এটাই প্রত্যাশিত। তবে এর চেয়েও বেশি কাম্য, সবাই যেন পবিত্র রমজান ও ঈদের প্রকৃত মর্মবাণী অনুধাবন করেন।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়