
আদিকাল থেকেই সন্দ্বীপবাসীর সংগ্রামী জীবন ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের কোলে নোনা জলরাশি ঘেরা দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। মাত্র ৭৫০ বর্গকিলোমিটারের এক টুকরো সমুদ্র সন্তান। চার লাখ সন্দ্বীপবাসীর যাতায়াতের জন্য রয়েছে কুমিরা-গুপ্তছড়াসহ ছয়টি নৌপথ। যাত্রাপথের সীমাহীন ভোগান্তি, জীবনহানি, আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির বেড়াজাল ডিঙিয়ে প্রাপ্তির উষালগ্নে উচ্ছ্বাসের ঢেউ খেলছে দ্বীপবাসীর সামনে। নতুন স্বপ্ন বুনছেন তারা জনপদটি নিয়ে। দেশে এই প্রথম উপকূলীয় ফেরি সার্ভিস চালু হয়েছে সন্দ্বীপে। এর মাধ্যমে দেশের অন্যতম একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ মূল ভূখণ্ডের যাতায়াত ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত হলো। রেল কিংবা সড়ক পথে ঢাকা অথবা চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড নেমে ঝুঁকিপূর্ণ সাগর যাত্রা, বর্ষা কিংবা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মৌসুম হলে তো কথাই নেই। জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে স্বজনদের কাছে যাওয়ার দুর্ভোগ শেষ। এখন ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে মানুষ সরাসরি সন্দ্বীপে চলে যেতে পারবে ফেরিতে। ফলে সন্দ্বীপে নতুন করে সম্ভাবনার আলো জ্বলেছে।
সন্দ্বীপের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপেও রয়েছে রেমিটেন্স যোদ্ধা। এখানে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। প্রকৃতির অপার সম্ভাবনার ফলে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক বিস্তার ঘটলে স্থানীয়দের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিগন্তও উন্মোচিত হবে। সীতাকুণ্ড স্থলভাগ থেকে বঙ্গোপসাগর চ্যানেলে সন্দ্বীপের দূরত্ব প্রায় ১০ মাইল। উত্তাল সাগর পথ পাড়ি দিয়ে সন্দ্বীপ পৌঁছানো ছিল এক জলসংগ্রাম যাত্রা। মৌসুমের স্বাভাবিক সময়ে ছোট-বড় নৌযানে কোনোমতে সন্দ্বীপ পৌঁছানো গেলেও তীরে নেমে দীর্ঘ কর্দমাক্ত পথ মাড়িয়ে হাঁটার দুর্ভোগ ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। বর্ষাকালে সাগর উত্তাল থাকলে সন্দ্বীপ পৌঁছানো রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিল। হাজার বছরের পথচলায় এ অঞ্চলের অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নৌ দুর্ঘটনায় অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ উপকূলে পৌঁছানোর পর সি-ট্রাক থেকে যাত্রী নামানোর সময় ‘লালবোট’ (উপকূলে যাত্রী নামানোর ছোট নৌকা) ডুবে ১৮ জন প্রাণ হারান। এ ঘটনা ‘সন্দ্বীপ ট্র্যাজেডি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল স্পিডবোট ডুবে একই পরিবারের তিন শিশুসহ মৃত্যু হয় চারজনের। এ রকম দুর্ঘটনা ঘটে থাকে প্রায়ই। ফেরি চালু হওয়ায় হাজার বছরের দুর্ভোগ থেকে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে সন্দ্বীপবাসী।
গত সোমবার সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া থেকে গুপ্তছড়া ফেরিঘাট নৌপথে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরি চালু হওয়ায় সন্দ্বীপে যাত্রীবাহী ও মালামালবাহী যানবাহন চলাচলও শুরু হয়েছে। ঈদুল ফিতরে দ্বীপবাসীর জন্য এ এক অনন্য উপহার। উদ্বোধনী ফেরিতে সাতজন উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার দুজন বিশেষ সহকারী উপস্থিত থাকায় এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। ১৯ মার্চ দুপুরে নির্ধারিত ফেরি ‘কপোতাক্ষ’ পরীক্ষামূলকভাবে সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া থেকে সোয়া এক ঘণ্টায় সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ফেরিঘাটে পৌঁছায়। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাগর উত্তাল না থাকলে এর চেয়ে বেশি সময় লাগবে না। ফেরিতে বাস, ট্রাক, ট্যাঙ্কলরি, মিনিবাস, প্রাইভেটকারসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে পারবে। ধারণক্ষমতা ২৪টি পণ্যবোঝাই ট্রাকের সমান। এ রুটে চলাচলের জন্য আরও একটি ফেরি নির্মাণাধীন রয়েছে। আপাতত কপোতাক্ষ ফেরিটি দিনে একবার সীতাকুণ্ড থেকে সন্দ্বীপ যাবে এবং সেখান থেকে আবার ফিরে আসবে। এর ফলে সন্দ্বীপবাসীর দীর্ঘ দিনের স্বপ্নপূরণ হলো অন্তর্বর্তী সরকারের কল্যাণে।