ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ৩০ মার্চ ২০২৫, ১৬ চৈত্র ১৪৩১

‘স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও দেশ নির্মাণের খোঁজ’

শায়রুল কবির খান

প্রকাশিত: ১৩:১৫, ২৭ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ১৩:১৮, ২৭ মার্চ ২০২৫

‘স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও দেশ নির্মাণের খোঁজ’

ছবি : জনকণ্ঠ

দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে— স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। দেশটির প্রধান সত্ত্বা গণতন্ত্র, এই গণতন্ত্রের আকাঙ্খা নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। লাখো শহীদের রক্ত ও মা-বোনের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে যে আকাঙ্খা নিয়ে অর্জন হয়েছিল, তা স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে।

তবে স্বাধীনতার হিরন্ময় ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) পচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আসার মধ্যে দিয়ে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে শুরু করে। তিনি একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন।  মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি বদনাম গুছিয়ে আধুনিক স্বনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে সামনে আসে। 

আমাদের কাছে একাত্তর শুধু মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন ও সংগ্রাম নয়; আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়, এটি আমাদের জাতীয় সত্ত্বার কেন্দ্রবিন্দু। দেশের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা এবং দেশপ্রেমের চেয়ে বড় প্রেম হতে পারে না। কিন্তু আজ ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও একাত্তর নিয়ে দেশ এক অমোঘ বাস্তবতার মুখোমুখি। কতটা অপরিপক্কতা থাকলে কেউ-কেউ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের তুল্য করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-কে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলতে পারেন!

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদ স্বাধীনতার সেই আকাঙ্ক্ষাকে চেতনার নামে লুণ্ঠিত করে জাতির সাথে প্রতারণা করেছে। একইসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ব্যক্তি স্বার্থপরতাও। এর রেশ ধরে সৃষ্টি হয় দলীয় বিভক্তি। যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় সামাজিক বিভক্তি। ছিলো ক্ষমতার অপব্যবহার ও লাগামহীন লুটপাট। এ নিয়ে আলোচনা বা বিতর্কের চেয়ে অতীতকে হাতের তালুয় রেখে গণতন্ত্র উত্তরণে সবার ঐক্য ও একনিষ্ঠ লক্ষ্য স্থির করার বাইরে কোনও বিকল্প নেই। 

যে কারণে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম-এর দেখানো পথ "বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ" দর্শন এবং "১৯-দফা" কর্মসূচিই আমাদের সামনে অন্যতম প্রধান মুক্তির উপায়। যার ওপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ ও বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা রূপরেখা বাস্তবায়নই হবে প্রধান পদক্ষেপ। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু অস্ত্রের লড়াই ছিল না। এটি ছিল আমাদের জাতীয় পরিচয়, ভাষা এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের জন্য লড়াই। একজন কৃষক, একজন ছাত্র, একজন গৃহিণী— প্রত্যেকেই এ যুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশমাতৃকার জন্য এ ত্যাগ কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, বরং সমষ্টিগত মুক্তির লক্ষ্যে ছিলো। 
 
বর্তমান প্রজন্মের সামনে একাত্তরের আকাঙ্খাকে চেতনার নামে ইতিহাসের পাতায় শুধু স্মৃতিসৌধ ও তাদের দলীয় পারিবারিক কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ করেছিলো আওয়ামী ফ্যাসিবাদ । তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একটি শোষণমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতার স্বার্থ রক্ষা করে চলা। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা কল্পনা করেছিলেন এমন একটি বাংলাদেশ— যেখানে মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না, যেখানে স্বাধীনতার সুফল সবার কাছে পৌঁছাবে। তৈরি হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধের আকাঙক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, তার বড় সমস্যা হলো মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে চেতনার নামে বিকৃত করে প্রথাগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা। একাত্তরের প্রত্যাশাকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এই বিভ্রান্তিকর প্রক্রিয়া দেশের ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত স্বাধীনতার অর্জন ধরে রাখা এবং সঠিক পথে পরিচালিত করা এখন ততটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য।

দলীয় স্বার্থের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে দেশের সম্পদ অপব্যবহারের নজির প্রতিনিয়তই বাড়ছে। অথচ একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি ছিল ঐক্যের, ত্যাগের এবং সাধারণ মানুষের অধিকারের। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে একাত্তরের গল্প শুধু আমাদের অতীত নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একাত্তরের আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করা আজ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তরুণরা এই আঙ্ক্ষা কীভাবে ধারণ করবে?  

স্বাধীনতার ইতিহাসকে রাজনৈতিক মতাদর্শের আলোকে না দেখে এই বিভাজনকে দূর করতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং পরিবারকেন্দ্রিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। একাত্তরের সত্য ঘটনাগুলো তুলে ধরে তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শুধু ইতিহাস জানালেই কি হবে? তরুণদের মধ্যে ত্যাগ, দায়িত্ববোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের চেতনাও গড়ে উঠতে হবে। কেবল বই পড়ে বা বক্তৃতা শুনে নয়, তরুণদের বাস্তব জীবনে এসব মূল্যবোধের চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করে দেবেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ। দেশ পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে পারলে এই তরুণ প্রজন্ম গঠনমূলক লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠবে এবং গোড়ায় যা ছিল তা হয়তো কিছুটা হলেও খোঁজে নিতে সমক্ষ হবে আজকের ও আগামী প্রজন্ম।

 

লেখক পরিচিতি:
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
 

/মো. মহিউদ্দিন

×