
ইসরাইলের এমন অকল্পিত ভয়ঙ্কর আক্রমণে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। প্রবীণ, তরুণ, শিশু, নারী, পুরুষ সকলের জীবনই সেখানে চরম বিপন্ন। কারও জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। নেই কোনো নিশ্চিত বাসস্থান। যাযাবরের মতো প্রাণ সংকটে ঘুরে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। শিশু ও নারীর কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে গাজার আকাশ-বাতাস। মানুষের হাহাকারে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে সেখানকার জনজীবন। ফিলিস্তিনের মানুষের আহাজারি ও বিলাপে বাকরুদ্ধ পুরো বিশ্ব।
ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের এই দ্বন্দ্বের ইতিহাস অনেক পুরানো। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে মাছের ভাগার মতো ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় ব্রিটেন ও ফ্রান্স। ১৯১৭ সালে জেমস বেলফোর ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন; যা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত। বেলফোর ঘোষণার পর ইউরোপ থেকে বহু ইহুদি ফিলিস্তিনে এসে বসবাস করতে থাকে।
আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ইহুদি নিধনের মধ্য দিয়ে ইহুদিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করে ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষ। সে কারণেই ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পায় ভূমির প্রায় ৫৭ শতাংশ এবং ফিলিস্তিনিরা মাত্র ৪৩ শতাংশ। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত দ্বন্দ্ব তথা যুদ্ধ চলছেই। মৃত্যুর পর মৃত্যু, সংঘাতের পর সংঘাতেও কোনোভাবেই এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান হয়নি। কর্তাব্যক্তিগণ বড় কোনো মৃত্যুর পাহাড় সৃষ্টি হলে তখন শুধু একটি মৌখিক ও লৌকিক শোক প্রকাশ করে বিশ্ববাসীকে সান্ত্বনা দেয় যে, আমাদের হৃদয়ও পাথর দিয়ে তৈরি নয়। আমরাও শোক প্রকাশ করতে পারি, এই শোক বার্তা তার প্রমাণ। এভাবে সেই শুরু থেকেই কেবল লৌকিক শোক প্রকাশই করে যাচ্ছে বিশ্বের মোড়লগণ। কিন্তু এই সংঘাত নিরসনের জন্য তাদের আন্তরিক উদ্যোগ আজও চোখে পড়েনি।
কুরুক্ষেত্রের মহারণে আর্যাবর্তের অজস্র প্রাণের যে চিতাবহ্নি রচিত হয়েছিল, সে চিতাকে ন্যায়ের বিশুদ্ধ চিন্তার প্রকোষ্ঠে সৃজিত করবে যারা, সেই মহারথীরাই সেদিন হয়ে উঠেছিল পক্ষপাতদুষ্ট। তারাই সেদিন যুদ্ধ করেছিল হাতে রক্তের দাগ নিয়ে। কুরুক্ষেত্রের বুকে তারাই সেদিন রচনা করেছিল মৃত্যুর সজ্জা। সেদিন যদি দেবব্রত মহামহিম ভীষ্ম ও গুরু দ্রোণাচার্য শক্ত হাতে কঠোরচিত্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে এত বিপুল প্রাণের বিসর্জন হয়তো এড়ানো যেত।
ইসরাইল ফিলিস্তিনের আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো বোমা হামলা করছে। সে হামলার আঘাতের লেলিহান দাবানলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে পুরো গাজাভূখণ্ড। চিলে আক্রমণ করলে পাখির বাচ্চারা যেমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচির তুফান তুলে লুকোতে চায় কোনো নিশ্চিত আশ্রয়ে, ঠিক তেমনি সেখানে থাকা ছোট ছোট শিশুরা ভীষণ আতঙ্কে চিৎকার চেঁচামেচি করে একটু বেঁচে থাকার আশ্রয়ের খোঁজে গুটি গুটি পায়ে দিগি¦দিকশূন্য হয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। চারপাশজুড়ে মানবসৃষ্ট এই আগুনের ভয়ংকর দাবানলে পুরো শহর পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। একটি ছোট শিশুকে দেখা গেল ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভাঙ্গা কংক্রিটের ভেতর চাপা পড়ে ছটফট করে কাতরাচ্ছে। শরীর মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এমন অমানবিক নিষ্ঠুর দৃশ্যে যাদের মানবিক জাগরণ না ঘটে এবং শুধু লৌকিক শোক প্রকাশে যারা সীমাবদ্ধ থেকে কেবল কাগজের অপচয় করছে, তাদের হৃদয়ে দুঃখ-বেদনা আসলে কতটুকু আছে সেটা বিপুল সন্দেহের বিষয়। এখনই দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে কেন এর সুনির্দিষ্ট সমাধান করা হচ্ছে না বা চেষ্টা করা হচ্ছে না, সেটা অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করে মানুষের মনে।
যে বয়সে শিশুদের বই-খাতা নিয়ে নির্বিঘ্নে স্কুলে যাওয়ার কথা, নতুন কিছু শেখার মাধ্যমে নিজেদের ভিত মজবুত করার কথা, প্রাণভরে উচ্ছ্বাসে বাঁচার কথা; সেই বয়সে তারা গোলাবারুদ, বোমা, পৃথিবীর স্বার্থপর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবাদীদের স্বার্থপর আচরণ, বিভীষিকাময় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। ওই শিশুরা নিজেদের ভেতর ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য কোন্ শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠবে, তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।
কত স্বপ্ন দিয়ে গড়া সংসার, কত আবেগ দিয়ে নির্মিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তÑ অথচ সে সংসার, ঘর, পরিবার সবই অল্প সময়ের মধ্যেই মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন দেহে মানুষের জীবনের করুণ গল্পের অযাচিত অশোভন অবসান হচ্ছে। শিশুরা বড় হচ্ছে একটি ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারগ্রস্ত মস্তিষ্ক নিয়ে। চারপাশজুড়ে অদ্ভুত এক ভয় ঘিরে রেখেছে মানুষের মন।
আমরা অবশ্যই এই বিপর্যয়, হত্যা, খুন ও সংঘাতের জরুরি অবসান চাই। আমরা গাজাবাসীর মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করে ব্যথিত হৃদয়ে বিশ্বের নেতাদের কাছে আবেদন জানাই, তারা যেন স্বার্থের চেতনাজাগ্রত ঘুমের অভিনয়ের পারদর্শিতা না দেখিয়ে, প্রচণ্ড বিবেকের চপেটাঘাতে জাগ্রত হয়ে যথাযথ হস্তক্ষেপে উল্লেখযোগ্য সমাধানে অবিলম্বে বন্ধ করে দেয় এই রক্তের জোয়ার। মানুষের ক্রন্দন, রক্তের প্রবাহে বিশ্বমানবতার হৃদয়ে গভীর রক্তক্ষরণ হয়ে কেঁপে ওঠে সমগ্র মানবিক প্রাণ। তাই সবার একত্রিত সিদ্ধান্তে বন্ধ হোক এই যুদ্ধের দামামা। পৃথিবীব্যাপী বেজে উঠুক শান্তির তূর্য।
যারা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহীতা, যাদের হাতে রয়েছে এই রক্তের দাগ মুছে ফেলার শক্তি, যারা চাইলেই এই যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, আমরা চাই তারা কঠিন ও কঠোর হস্তে এই যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে যথাযথ উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করুক।