ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৯ মার্চ ২০২৫, ১৫ চৈত্র ১৪৩১

বিশ্বব্যাপী বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২০:০৭, ২৬ মার্চ ২০২৫

বিশ্বব্যাপী বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য

বিশ্বব্যাপী বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। বিশ্বের কিছুসংখ্যক মানুষ বেশির ভাগ সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে। ফলে শোষণ বাড়ছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনী ২ হাজার ১৫৩ জন,  দরিদ্রতম ৪৬০ কোটি লোকের মোট অর্থের চেয়েও বেশি অর্থ ২০১৯ সালে নিয়ন্ত্রণ করেছে বলে জানিয়েছে অক্সফাম। অথচ মজুরিহীন ও কম মজুরি পাওয়া নারী ও মেয়েদের শ্রম প্রতি বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রযুক্তি শিল্পগুলোর চেয়ে তিনগুণ বেশি মূল্য সংযোজন করছে বলে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাটি জানিয়েছে। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতাদের বার্ষিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম সম্মেলনের আগে এক প্রতিবেদনে অক্সফাম এমনটি জানিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী নারীরা বিনা বেতনে বা স্বীকৃতি ছাড়াই প্রতিদিন মোট এক হাজার ২৫০ কোটি ঘণ্টা কাজ করছে। ‘টাইম টু কেয়ার’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে অক্সফাম জানায়, তাদের হিসাবে নারীর মজুরিহীন সেবা কাজ প্রতি বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্তত ১০ লাখ ৮০ হাজার কোটি ডলার মূল্য যোগ করছে। এটি প্রযুক্তিশিল্পের যোগ করা মূল্যের তিনগুণের বেশি।
অক্সফাম ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী আমিতাভ বেহার রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যে অর্থনীতি আমরা দেখছি সত্যিকারভাবে নারীদের মজুরিহীন সেবাই তার অলক্ষ্যে থাকা ইঞ্জিন, আমাদের এখানে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এটির পরিবর্তন হওয়া দরকার। বিশ্বের সেরা ধনীরা তাদের ব্যক্তিগত বিমান, ব্যক্তিগত জেট ও বিলাসবহুল জীবনধারা নিয়ে আছেন। আমাদের এটি পরিবর্তন করা দরকার। আর নিশ্চিতভাবে এই বিলিয়নিয়ারের বাড়-বাড়ন্তেরও ইতি ঘটানো দরকার।’ তিনি বলেন, বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ৩০টির বেশি দেশে প্রতিবাদ বিশেষত হচ্ছে। লোকজন রাস্তায় নেমে এসেছে। কী বলছে তারা? তারা এই বৈষম্যকে মেনে নেবে না। তারা এ ধরনের পরিস্থিতিতে আর জীবনযাপন করতে চায় না। এ সমস্যা কেবল বৈশ্বিক নয়, এটা বাংলাদেশেরও সমস্যা। এখানে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। বাংলাদেশেও নারী তার শ্রমের সঠিক মূল্য পাচ্ছে না। উপরন্তু তারা নানা ধরনের শোষণ-বঞ্চনা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর প্রধান কারণ দেশে অসুস্থ ও অসম পুঁজির বিকাশ। ১০ বছর আগে যিনি ফুটপাতে হাঁটতেন, ঠিকমতো সংসার চালাতে পারতেন না, এখন তিনি কোটিপতি। দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশে খুব সহজেই ধনী হওয়া যায়। ক্ষমতা ও রাজনীতির প্রভাব বলয়ে থেকে মানুষ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এবং দ্রুত ধনী হচ্ছে। অথচ বলা হয়ে থাকে কোনো ব্যক্তি যদি টানা ১৬ ঘণ্টা ৩২ বছর পরিশ্রম করেন, তবে তার পক্ষে কোটিপতি হওয়া সম্ভব। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এখন আর কেউ পরিশ্রম করে ধনী হতে চায় না। দেশের ৯০ ভাগ মানুষের স্বপ্ন কোটিপতি হওয়া।
আজ যে সাধারণ মানুষ, চাষি-মজুর সে খুব কঠিন জীবনযাপন করছে। একুশ শতকেও এই ভয়াবহ চিত্র চোখে পড়ে। প্রকৌশল ও প্রযুক্তির অস্বাভাবিক উন্নতি হয়েছে। পাইলট ছাড়াই বিমান বোমা ফাটাচ্ছে। হাজার হাজার শিশু মারা যাচ্ছে। নর-নারী ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। কয়েকটি দেশে প্রাচুর্য উপচে পড়ছে। অথচ কয়েকশ’ কোটি মানুষ না খেয়ে মরছে। উপোস করছে। নির্ভর করছে জাতিসংঘের সাহায্যের ওপর।
অনেকে মনে করেন। দেশে দুধের নহর বয়ে যাচ্ছে। অথচ বাস্তব চিত্র ভিন্ন। নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন। মাছ-মাংসের দামে আগুন। কামলাগিরি করে যারা খান, মুটে-মজুর, অল্প টাকার মাইনের শ্রমিক; সামান্য বেসরকারি চাকুরেÑ সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। কীভাবে দিন যাবে। গ্রামে কামলা ও ভূমিহীন চাষির কাজ নেই। দলে দলে মানুষ শহরে আসছে, কাজের খোঁজে। কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। কেউ রিক্সা টানছে। তারপর কাজ আছে জেনে আবারও গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু সবাই তো রিক্সা টানতে পারে না। তাই চোর-বাটপার-দুর্নীতিবাজরা ভালো আছে।
দারিদ্র্য বিমোচনের কথা যে আমরা বলি, এখনো দেশে ২২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। দেশের অনেক মানুষ যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই আছে। দেশের সাধারণ মানুষের দিকে, গরিবদের দিকে নজর দেওয়ার কেউ নেই। দেশে ছিনতাই, গুম, অপহরণ, হত্যা বাড়ছে। রাজনৈতিক চোর-ডাকাত বাড়ছে। বাড়ছে টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, ভর্তিবাণিজ্য, দখলবাণিজ্য। বাড়ছে খুন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, শিশু ও নারী নির্যাতন। এসব সবাই জানে। শুধু জানে না কীভাবে প্রতিকার হবে। দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এ বিপুল জনসংখ্যার দেশে খুব কম লোকই আছেন যারা দেশের কথা ভাবেন। এ এক আশ্চর্য দেশ। এমন অবস্থায় শ্রেণি-বৈষম্য, ধন-বৈষম্য বাড়বেই বাড়ছেও।
জনগণের সঙ্গে কে থাকবে? দেশের কথা কে ভাববে? জনগণের কথা কে চিন্তা করবে? দেশের শ্রীবৃদ্ধি কে ঘটাবে? দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে কে? কেন কোটি কোটি মানুষ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে না? কেন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করছে না বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ন্যূনতম বাঁচার দাবি কেন পূরণ হবে না? কেন পণ্যমূল্য সহনীয় থাকবে না? কেন থাকবে না বাসস্থান? কেন থাকবে না বস্ত্র? কেন পাবে না শিক্ষা? কেন পাবে না স্বাস্থ্যসেবা? সঙ্গত কারণেই এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসে।
তরুণদেরও ভাবতে হবে এসব কথা। তাদের বের করতে হবে পথ। চিহ্নিত করতে হবে কোন পথে মানুষের মুক্তি। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের একাংশ এখনো পচে যায়নি। তারা এখনো টেন্ডারবাজি করে না। তারা ভর্তি ফরম বিক্রি করে না, করে না প্রশ্ন ফাঁস। তারা ছিনতাই করে না। তারা নদী দখল ও দূষণ করে না। তারা দেশে-বিদেশে নানা উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে ও করছে।
দেশে সাম্যের পথ কণ্টকাকীর্ণ, কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এটা লক্ষ্য রাখতে হবে তরুণ সমাজকে। উপরন্তু তাদের দমন করতে হবে লোভ-লালসা। তরুণরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, তারা পারবে বিপ্লব ঘটাতে। শোষণের ইতি ঘটাতে। বৈষম্যের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে। তরুণদের প্রতি আমাদের আবেদন, তোমরা জাগো। সমাজের অসাম্য ও অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের মূলে কুঠারাঘাত করো। মানুষ মানুষে যে ভেদাভেদ, সমাজের মধ্যে যে পার্থক্য, যে শোষণ, তা চূর্ণ করো। প্রতিবাদী চেতনার আগুন জ্বালাও।
নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আশার কথা, দেশের মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে সচেতনতা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক তৎপরতা সৃষ্টি হচ্ছে। সবাই একটু ভালো থাকতে চায়। সচ্ছল থাকতে চায়। এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক দিক। এ জন্য প্রয়োজন সুযোগ সৃষ্টি করা। সমাজের নিম্নস্তরে যারা আছে, যাদের অর্থনৈতিক জীবন সচ্ছলতাহীন, তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ দেশের সাধারণ মানুষের চাহিদা সামান্য। অল্পে তুষ্ট মানুষ খেয়েপরে নিরাপদে বেঁচে থাকতে চায়। এ দেশের মানুষ মাঠে-ঘাটে কাজ করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। এসব উদ্যোগী ও পরিশ্রমী মানুষকে সংগঠিত করা গেলে এবং তাদের সহযোগিতা করা সম্ভব হলে সার্বিকভাবে দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। খুলে যাবে সম্ভাবনার দুয়ার। পরিকল্পিত উপায়ে অগ্রসর হলে আমাদের সফলতা অনিবার্য।
যুবসমাজ বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চাবিকাঠি। উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুবসমাজকে কাজে লাগাতে হবে। বেকারত্ব নিরসনে বৃহৎ কাজের বাজার সৃষ্টি করতে হবে। সমাজের মানুষের মধ্যে সমৃদ্ধির চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। ইতিবাচক উদ্যোগ, আয়োজন, সম্ভাবনা ও সাফল্যের দৃষ্টান্ত ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। এতে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হবে। দেশের জনসংখ্যা সমস্যা নয়, বরং দক্ষ জনশক্তিই বিপুল সম্ভাবনার ক্ষেত্র। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মেধা আর ৩২ কোটি দক্ষ কর্মীর হাতের পরশে যে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব। এজন্য রাষ্ট্রকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। কমাতে হবে অর্থনৈতিক বৈষম্য। নির্মূল করতে হবে দুর্নীতি ও নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ।
আমরা বিশ্বায়নের এই পরিবর্তনশীল সময়েও ম্যাক্রো-অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। রপ্তানি আয়, রেমিটেন্স আয় বাড়ছিল বলে দেশের ম্যাক্রো অর্থনীতি এতটা ভালো ছিল। এ দুটো জায়গায় এখন খানিকটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দূরদর্শী নীতি গ্রহণ করে বহু কষ্টে অর্জিত ম্যাক্রো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি কৃষির আধুনিকায়ন ও বহুমুখীকরণের কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোতেও গরিব-সহায়ক বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক আধুনিকায়ন ও যন্ত্রায়নের কারণে ভূমির ব্যবহারেও এসেছে পরিবর্তন। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো পূরণে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সমন্বয় করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এসব করা সম্ভব হলে অর্থনৈতিক বৈষম্য হয়তোবা কিছুটা কমে আসবে বলে আমরা আশাবাদী।


লেখক :  সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

×