
বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, সংগীতজ্ঞ সন্জীদা খাতুনের জীবনাবসান পরিণত বয়সে হলেও এমন পুরোধা ব্যক্তিত্বের চলে যাওয়া আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য এক বড় দুঃসংবাদ। শিক্ষক, গবেষক, সংগীতজ্ঞ, সংগঠক, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, পদ্মশ্রী, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্যসহ অসংখ্য সম্মাননাপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. সন্জীদা খাতুনের প্রয়াণ বাঙালির অপূরণীয় ক্ষতি। রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ছিলেন তিনি। শুদ্ধ সুর ও বাচনে পরিশীলিত সুরেলা কণ্ঠে তাঁর পরিবেশিত রবীন্দ্রনাথের গানের মুগ্ধ অনুরাগী ছিলেন সুধী সারস্বত সমাজের বিশিষ্টজন। তিনি শুধু আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন শিল্পী গড়ার কারিগরও। তিনি ছিলেন সুরের সাধক ও সংস্কৃতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
২৬ মার্চ দুপুরে ড. সন্জীদা খাতুনের কফিন শেষবারের মতো ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে নেওয়া হলে তৈরি হয় শোকের আবহ। গান আর ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানান সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, শিল্পী, ছায়ানটের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মীসহ অসংখ্য মানুষ। ২৫ মার্চ মঙ্গলবার দুপুর ৩টা ১০ মিনিটে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ ছুঁই ছুঁই। বুধবার ছায়ানট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে তাঁর কফিন নেওয়া হয়। এরপর নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে তাঁকে শেষবিদায় জানান সর্বস্তরের মানুষ।
প্রথম জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। লেখক-গবেষক হিসেবে তাঁর প্রকাশনাও কম নয়। তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ : ধ্বনি থেকে কবিতা, অতীত দিনের স্মৃতি, তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে, কাজী মোতাহার হোসেন, রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে, ধ্বনির কথা আবৃত্তির কথা, সংস্কৃতির বৃক্ষছায়ায়, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের গান, সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রাম, জীবনবৃত্ত, শান্তিনিকেতনের দিনগুলো। সংগঠক হিসেবে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে। ১৯৬১ সালে ছায়ানট সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের জন্মকাল থেকে সক্রিয়ভাবে যুক্ত, ১৯৭২ সাল থেকে ‘ছায়ানট সংগীতবিদ্যায়তন’-এর অবৈতনিক অধ্যক্ষ, ২০০১ সাল থেকে ছায়ানটের সভাপতি, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নালন্দা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
তাঁর প্রয়াণ কেবল তাঁর হাতে গড়া ছায়ানট, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ বা নালন্দার জন্য নয়, যারা বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সুস্থ ধারা এবং মানবিক সমাজ গড়ায় আগ্রহী, তাদের সবার জন্যই দুঃসংবাদ। মুক্তচিন্তা ও সংগীতের পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্জীদা খাতুন যেন বাঙালি জতিসত্তাকে হৃদয়ে ধারণ করে বিশ্বমানব হয়ে ওঠেন, সেই সাধনা করে গেছেন সারাটি জীবন। সংগীতের শুদ্ধরূপ ও জাতীয় সংস্কৃতির সুরক্ষা এবং ধর্মবিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ও নৈতিক অবক্ষয় রোধে সর্বজনশ্রদ্ধেয় দৃঢ়চিত্ত সন্জীদা খাতুনের সক্রিয় উপস্থিতি আমাদের সমাজের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। তাই তাঁর প্রস্থান সারস্বত সমাজ ও দেশের সংস্কৃতির অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে নিদারুণ এক শূন্যতার সৃষ্টি এবং মর্মবেদনার। আমরা জানি, মানুষ তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই স্মরণীয় হয়ে থাকেন। এই মহীয়সী বাঙালি সমাজে স্মরণীয়-বরণীয় এবং প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন চিরদিন।