
নাটক শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি সমাজের প্রতিচ্ছবিও বটে। মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই নাটক মানুষের হাসি-কান্না, প্রেম, বিদ্রোহ ও স্বপ্নকে ধারণ করেছে। মঞ্চের আলো নিভে গেলেও, চরিত্রগুলোর কণ্ঠস্বর সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিধ্বনিত হয়। এই নাট্যচর্চার গৌরবময় ঐতিহ্যকে উদযাপন করতেই ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বনাট্য দিবস (World Theatre Day)। যা প্রতি বছর ২৭ মার্চ সারা বিশ্বে পালন করা হয়।
১৯৬১ সালে International Theatre Institute (ITI) এই দিনটি প্রতিষ্ঠা করে। যার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাপী নাট্যচর্চাকে উজ্জীবিত করা এবং থিয়েটারের মাধ্যমে সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সংলাপকে তুলে ধরা। এই দিনটি শুধু নাট্যকর্মীদের জন্যই নয়, বরং নাটকপ্রেমী, দর্শক ও শিল্প-সাহিত্য অনুরাগীদের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রতি বছর একজন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব বিশ্বনাট্য দিবসের বার্তা প্রদান করেন, যা আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশের নাট্যচর্চা দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী। আমাদের লোকনাট্য যেমন-যাত্রা, গম্ভীরা, পালাগান, আলকাপ, এগুলো গ্রামীণ সমাজে বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে মঞ্চনাটকের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। স্বাধীনতার পর নাট্যচর্চা আরও গতিশীল হয় বিশেষ করে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে আতাউর রহমান, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূরসহ অনেকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গড়ে তোলেন, যা দেশে নাট্য আন্দোলনের ভিত মজবুত করে। এরপর নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, আরণ্যক, থিয়েটার (বেইলি রোড), ঢাকা থিয়েটার-এর মতো দলগুলো আধুনিক বাংলা মঞ্চনাটকে নতুন মাত্রা যোগ করে। সেলিম আল দীন, মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন, সফদার হাশমির মতো ব্যক্তিত্বরা আমাদের নাট্যধারায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
নাটক সমাজের দর্পণ। বিশ্বে থিয়েটার বহুবার বিদ্রোহ ও পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রিসের সোফোক্লিসের নাটক থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ার, মলিয়ের, ব্রেখট, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, বাদল সরকার, সেলিম আল দীনের নাটক—সবই সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র আন্দোলন ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে নাটকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে আমাদের নাট্যদলগুলো রাজনৈতিক ও সামাজিক অসঙ্গতির বিরুদ্ধে মঞ্চনাটককে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছে।
আজকের ডিজিটাল যুগে নাটকের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ এসেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, টেলিভিশন, সিনেমার আধিপত্যের কারণে মঞ্চনাটকের দর্শক কমছে। নাট্যশালাগুলোর আর্থিক সংকট, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং মহামারির অভিঘাতে অনেক নাট্যদল সংকটে পড়েছে। প্রযুক্তি ও সৃজনশীলতার মিশেলে নতুন ধরনের থিয়েটার চর্চা গড়ে উঠছে। এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার, ইন্টারঅ্যাকটিভ থিয়েটার, স্ট্রিট থিয়েটার, সোশ্যাল থিয়েটার-এর মাধ্যমে নাটকের নতুন ভাষা তৈরি হচ্ছে।
এই দিনটি শুধু নাটকের ইতিহাস স্মরণ করার দিন নয়, বরং থিয়েটারের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার দিন।
* নাটকের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন কীভাবে আনা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা।
* নতুন প্রজন্মকে নাট্যচর্চায় আগ্রহী করা।
* সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর দাবি তোলা।
* আন্তর্জাতিক থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাংলাদেশের নাট্যচর্চাকে আরও বিস্তৃত করা।
নাটক শুধুই বিনোদন নয়, এটি সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী মাধ্যম। বিশ্বনাট্য দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় নাটক শুধু মঞ্চে নয়, এটি মানুষের জীবনেরই আয়না। তাই থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখা মানে সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখা। পরিশেষে বলতে পারি, ‘মঞ্চের পরিসর ছোট হতে পারে, কিন্তু নাটকের শক্তি অপরিসীম।’
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়