
মানুষ স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। একাত্তরে বাঙালি জাতি স্বপ্ন দেখেছিল পরাধীনতার শিকল ভাঙার। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। মুক্তির স্বপ্ন। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। এ অধিকার কেউ কেড়ে নিতে ও খর্ব করতে পারে না। বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক রুশো বলেছেন, ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, কিন্তু জীবনের সর্বত্র থাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ’। দেখতে দেখতে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ৫৪ বছর হয়ে গেল।
বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম, যা কেবল ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নয়, বরং একটি শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন হলে ব্রিটিশ ভারতকে দুটি স্বাধীন অধিরাজ্য ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করে। ভারত থেকে পাকিস্তান বিভক্ত হয়ে যখন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান হয়, ঠিক তখনই শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অনিয়ম, অবহেলা, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং পদে পদে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করে, যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থবিরোধী ছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয় এবং সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই শহীদ হন। ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের জাতীয়তাবোধকে আরও উজ্জীবিত করে।
পশ্চিম পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান থেকে অধিক রাজস্ব আদায় করলেও পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়নে খুব কম ব্যয় করত। শিল্প, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন সবক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান এগিয়ে থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান বরাবরই অবহেলিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০% আসত পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি থেকে, কিন্তু উন্নয়ন ব্যয় হতো মাত্র ২৫%। সামরিক, প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য।
যখন কোনো দেশ অপর কোনো দেশ বা অঞ্চলকে শাসন এবং শোষণ করবে, ঠিক তখনই সর্বপ্রথম চিন্তা থাকে পদে পদে বঞ্চিত করা, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি দিন দিন পঙ্গু করে দেওয়া। ঠিক সেই কাজটি করেছিল পশ্চিম পাকিস্তান। তারা সর্বপ্রথম আঘাত করেছে আমাদের ভাষার ওপর। তারা চেয়েছে আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে। পরবর্তী সময়ে আমাদের অর্থনীতি।
এভাবেই ছাত্র আন্দোলন দিন দিন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনে যুক্ত হয় সব বয়স, পেশা এবং শ্রেণির মানুষ। অবশেষে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি তাদের মায়ের ভাষা রক্ষা করতে পেরেছে। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের পত্তন রচিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালি তাদের অধিকার রক্ষায় সব সময় সোচ্চার হয়। তারা তাদের অধিকার রক্ষায় ধীরে ধীরে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করে। বাঙালি সবকিছু ভুলে একতাবদ্ধ হয়ে দেশের জন্য, দেশের পতাকায় জন্য যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করে। তারা সবখানে প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ গড়ে তোলে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর শেষে নিঃসন্দেহে অনেক প্রাপ্তি প্রিয় মাতৃভূমির। মানবজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসিত হয়েছে। জানি, অন্তরায় অনেক আছে, কিন্তু তবু দেশের ভেতরে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বারবার উন্নয়ন আলোচনায় উঠে এসেছে। উদ্যোক্তা হিসেবে বহু খাতে নারীরা অগ্রণী হিসেবে কাজ করছেন। সামান্য মুঠোফোনের ওপর ভরসা করে তারা তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছেন। পোশাক শিল্পে মূলত তাদের অবদান থেকেই বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগের উৎপত্তি। প্রশাসনের নানা স্তর এবং পর্যায়েও তাদের সরব উপস্থিতি। সামাজিক অঙ্গনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। বহু ক্ষেত্রে তাদের অবদান পুরুষের অবদানকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রেই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
বাংলাদেশের তরুণ সমাজের কর্মকুশলতা, সৃজনশীলতা এবং সৃষ্টিশীলতা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমাদেরকে আশাবাদী করেছে। প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে তারা যেসব নতুন নতুন পদ্ধতি বা জ্ঞান সম্প্রসারণবিষয়ক কাজ করছেন তা দৃষ্টান্তমূলক। নানা ক্ষেত্রে নব্য জ্ঞান ও উদাহরণমূলক কাজের মাধ্যমে আমাদের তরুণ সমাজ দেশ ও সমাজের জন্য এক বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। এ অর্জন উদযাপিত হওয়া প্রয়োজন।
স্বাধীনতার ৫৪ বছরে সফলতার থেকে ব্যর্থতার পাল্লা বেশি ভারি। প্রতিটি সেক্টর বর্তমানে দুর্নীতি এবং অনিয়মে ভরে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে চিকিৎসালয় পর্যন্ত সব জায়গায় দুর্নীতিতে ভরে গেছে। বিভিন্ন চাকরিক্ষেত্র দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে।সঠিক বিচারের অভাবেই আজকে মাতৃভূমির এমন অবস্থা। এখনো নানা মৌলিক সমস্যা থেকে গেছে। যেটার সমাধান নাহলে দেশে কখনো স্থিতিশীল অবস্থা আসবে না। এখনো দেখা যায় একটা রাজনৈতিক দল আরেকটা দলকে সব সময় কোনঠাসা করতে ব্যস্ত। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে ঠিক তখনই বিরোধী দলকে হামলা, মামলা, জেল-জুলম দিয়ে শৃঙ্খলিত করে রাখে। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মানুষ তাদের অধিকারের জন্য মুখ খুলতে পারে না। অধিকারের প্রশ্ন আসলেই চলে আসে হামলা, মামলা, গুম ও খুন। দুর্নীতিবাজরা এখনও প্রকাশ্য নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে পাঁচ জন ধর্ষণের শিকার হয়। এখনো এসব ধর্ষক তাদের উপযুক্ত শাস্তি পায় না।
প্রিয় মাতৃভূমির এখন সময় এগিয়ে যাওয়ার। সব অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে দেশের স্বার্থে এবং দেশের মানুষের স্বার্থে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে একটা স্থিতিশীলতা খুবই দরকার। যেটার মাধ্যমে কাঁধে কাঁধ রেখে সবাই কাজ করতে পারবে এবং দেশের সব দুর্দিনে সবাই এক হয়ে প্রতিরোধ করতে পারবে। পাশাপাশি আইন আইনের গতিতে চলতে দিতে হবে। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে যখন যে সরকারই আসুক না কেন কেউ কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। যখন প্রতিটা সেক্টর এভাবে জবাবদিহির মধ্যে আসবে, ঠিক তখনই প্রিয় মাতৃভূমির সুদিন আসবে। এটিই আমাদের বিশ্বাস। এটিই আমাদের কামনা।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়