
ছবি: সংগৃহীত
মেজর হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রত্যেকটি পদে, প্রতিটি মুহূর্তে দেশের কথা ভেবেছেন শহীদ জিয়া। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করার পাশাপাশি তিনি শক্তভাবে হাত দিয়েছিলেন বিদেশনীতিতে।
আর রেখে গেছেন তাঁর অসামান্য কাজের অবিকল্প সব চিহ্ন। ১৯৮০ সালের ২৬ আগস্ট জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের একাদশ অধিবেশনের ভাষণে তৃতীয় বিশ্ব এবং বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে সুচিন্তিত বক্তব্য রাখেন। তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ এবং সেগুলোর সম্ভাব্য সমাধানের উপায়গুলোর দেশগুলোর ন্যায্য অধিকার ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করেন।নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেন। উত্তর-দক্ষিণ অর্থনৈতিক আলোচনা প্রসঙ্গে উন্নয়নগামী তাঁদের দাবি-দাওয়ার সপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
তিনি তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর সমস্যা সমাধানকল্পে ১০ দফা কর্মসূচি পেশ করেন। তাঁর সেদিনের বক্তব্য ও কর্মসূচি বিশেষভাবে অভিনন্দিত হয়। তাঁর সেই বক্তব্য বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। বার্মা শরণার্থীদের সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ১৯৮০ সালে প্রায় দুই লাখ বর্মী বা রোহিঙ্গা মুসলিম তাঁদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলো। তাঁদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে দেওয়া হয়েছিল আশ্রয় এবং করা হয়েছিলো যথাসাধ্য তত্ত্বাবধান, যেখানে আন্তর্জাতিক মতামত তাঁদের অবস্থানের সম্পূর্ণ অনুকূলে ছিল।
সে ক্ষেত্রে বার্মা সরকারের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকের ভিত্তিতে শরণার্থীদেরকে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । এটি ছিল শহীদ জিয়ার বিশ্ব রাজনীতির এক বিরাট সাফল্য। ১৯৭৮ সালে নিরাপত্তা পরিষদে সদস্য লাভের ক্ষেত্রে জাপানের সাথে বাংলাদেশের বিজয় এসব নীতির সাফল্যের চাক্ষুষ প্রমাণ। সেই সময়ে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর এবং জাতিসংঘে মাত্র ৪ বছর আগে বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভ করেছিলো।
৯৮০ সালে জাতিসংঘে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একটি অনির্ধারিত চুক্তিও হয়েছিল যে, ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের পরবর্তী সাধারণ অধিবেশনে এশিয়া থেকে কোনো দেশ সভাপতির পদ অলংকৃত করবে। বাংলাদেশ সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেই চুক্তি মোতাবেক ১৯৮০ সালে জাতিসংঘের সভাপতিত্ব নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ ও ইরাকের মধ্যে মৌখিক ভোট অনুষ্ঠিত হয়। উভয়পক্ষে ভোট সমান হলে ইরাক টসের মাধ্যমে সেই প্রতিযোগিতায় সভাপতির পদ লাভ করেছিলো। ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধের প্রয়াসে শহীদ জিয়ার উদ্যোগ আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। 'শাটলকক ডিপ্লোম্যাসি'র জন্য এক রাজধানী থেকে আরেক রাজধানীতে ছুটে যাওয়া দুপক্ষকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিবৃত্ত রাখার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা জিয়ার শান্তিবাদী চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ।
'পিস নেগোশিয়েটর' বা শান্তি আলোচক হিসেবে শহীদ জিয়া সেদিন বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে মুসলিম বিশ্বে সমুজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। মুসলিম উম্মাহর সংহতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করার জন্য সৌদি আরবের তায়েফে ওআইসির যে শীর্ষ বৈঠক বসেছিলো, সেখানে শহীদ জিয়াকে নির্বাচিত করা হয় সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান পদে। বাংলাদেশের জন্য এটা ছিল বিরল সম্মান । ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট জিয়া যখন চীন সফর করেন, তখন চীন সরকার এবং সেই দেশের মানুষ তাঁকে অভূতপূর্ব অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো । যখনই যেখানে গিয়েছেন, রাজপথের দু'পাশে দাঁড়িয়ে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তাঁকে ‘ওয়েলকাম ওয়েলকাম মংচিয়ালা মংচিয়ালা' (চীনা ভাষায় বেঙ্গল টাইগারকে বলা হয় ‘মংচিয়ালা হু’) ‘স্বাগতম স্বাগতম' বলে ফুল নেড়ে হাত উঁচিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো। একই রকম সম্মানে অভিষিক্ত হয়েছিলেন জাপান এবং যুগোস্লাভিয়ায় । একটি দরিদ্র দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা মনে করি, প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই অর্জন সত্যিই অহংকারের, গৌরবের।
১৯৮১ সালের গোড়ার দিকের কথা। কূটনীতির ক্ষেত্রে দাঁতাত-এর সার্থক প্রবক্তা ফেডারেল জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের নামে পরিচিত ব্রান্ট কমিশনের বৈঠক বসেছিলো লন্ডনে। এই কমিশন গঠিত হয়েছিল উত্তরের সম্পদশালী দেশগুলো থেকে দক্ষিণে দরিদ্র দেশগুলোতে বর্ধিত হারে সম্পদ প্রবাহের ক্রমবর্ধমান দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। কথা ছিল, নতুন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থা তথা নিউ ইন্টারন্যাশন্যাল ইকোনমিক অর্ডারের একটা সর্বসম্মত বাস্তব রূপরেখা প্রণয়নের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মিনি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে মেক্সিকোর কানকুনে। প্রস্তাবিত সেই মিনি শীর্ষ বৈঠকে কোন কোন দেশের নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো যায়, কী হবে তাঁর সম্ভাব্য ‘অ্যাজেন্ডা’, প্রধানত তা নিয়েই আলোচনা হয়েছিলো লন্ডনের সেই প্রস্তুতিমূলক সভায়। সভাশেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে কমিশনের মুখপাত্র হিসেবে ব্রিটেনের সাবেক টোরি প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ জানান, “বাংলাদেশের তরুণ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে আসন্ন ওয়ার্ল্ড মিনি সামিটে আমন্ত্রণ জানানোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।' তিনি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে সেই
সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের নেতার স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত বিশ্ববীক্ষা কাঙ্ক্ষিত নতুন আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থার গোড়াপত্তনে প্রভূত সহায়ক হবে বলে উদ্যোক্তাদের বিশ্বাস।' উন্নয়নশীল বিশ্বের মাত্র ৫টি দেশকে সেই বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিলো । বাংলাদেশ ছাড়া বাকি ৪টি দেশ ছিল যুগোস্লাভিয়া, ভারত, সৌদি আরব ও ভেনিজুয়েলা। বিশ্বরাজনীতিতে শহীদ জিয়ার এই স্বীকৃতি বাংলাদেশেরই গৌরবের সাক্ষ্যবাহী। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র বছর তিনেকের মধ্যে জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদে নির্বাচিত হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটা ছিল
একটা বড় ধরনের চমক।
কারণ, বাংলাদেশ এই সদস্যপদ লাভ করেছিলো জাপানের মতো প্রভাবশালী অর্থনৈতিক দানবকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে। এটা ছিল অনেকটা ড্যাভিড ও গণিয়াথের লড়াইয়ের মতো। এই যে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা, এটা বাস্তবরূপ লাভ করেছিলো শহীদ জিয়ার নেতৃত্বেরই গুণে ও কল্যাণে। বিসমার্কের এক বিখ্যাত উক্তি, 'পলিটিকস আর্ট অব পসিবল অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসি ইজ মেকিং ইম্পসিবল পসিবল'-এর সত্যতা প্রমাণ করেছিলেন শহীদ জিয়া তাঁর কূটনৈতিক দূরদর্শিতা, মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে। ভাবতেও আশ্চর্য লাগে, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল হেনরি কিসিঞ্জারের ভাষায় ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস' হিসেবে, সেই বাংলাদেশকেই মাত্র তিন বছরের মাথায় বিশ্বসভায় নিজের জন্য মর্যাদার আসন লাভে সক্ষম হলেন। জিয়া শহীদ জিয়ার অনুসৃত দূরদর্শী পররাষ্ট্রনীতির এটা একটা বড় সাফল্য।
মুসলিমবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে তিনি বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কেননা, তিনি মনে করতেন, হাজার বছর ধরে মুসলিমবিশ্বের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক রয়েছে। আজকের যে সৌদি আরব কিংবা ইয়ামেন, সেখান থেকেই ধর্মপ্রচারকরা একদিন আমাদের দেশে এসেছিলেন ধর্ম প্রচার করতে। তারপর তাঁরা এ দেশে স্থানীয়ভাবে থেকে গিয়েছিলেন। এজন্যই তিনি ১৯৭৬ সালে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে চায় । কারণ, তাঁদের সঙ্গে আমাদের ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন রয়েছে।' তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ৪২ সদস্যের ইসলামি সম্মেলনে যোগদান ছিল পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাঁর সর্বপ্রথম বিদেশে সফর। তুরস্কের জনগণ এবং সেই দেশের নেতৃবৃন্দের সাথে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে সেই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের অসামান্য সাফল্য বয়ে এনেছিলো।
১৯৭৬ সালের মে মাসে সৌদি আরবের বাদশার সঙ্গে তাঁর বৈঠক ছিল আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উল্লিখিত বৈঠকের পূর্বে দুই দেশের কোনো উচ্চপর্যায়ের নেতার সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি এবং সৌদি আরব বাংলাদেশকে বেশ কয়েক বছর যাবৎ স্বীকৃতিও দেয়নি। ১৯৭৬ সালের ১২ মে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সপ্তম সম্মেলনে যোগদানের পর বিশেষভাবে পরিচিত হন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। মন্ত্রী জিয়াকে সৌদি আরবে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালে শহীদ জিয়া সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন শেষ করে ঢাকা ফেরার পথে প্রথমে সৌদি আরবে এবং পরে ইরানে যান ।
শহীদ জিয়ার কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তার উদাহরণ ছিল সৌদি সরকারকে নিমগাছের চারা উপহার দেওয়ার মাধ্যমে, যা বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনের প্রতীক; বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আজিজের সাথে সাক্ষাতের সময় তাঁর কথা, ‘আপনার দেশে যার. অভাব রয়েছে, তা আমার মধ্যে প্রচুর সহযোগিতার জন্য একটি নতুন পথ নির্ধারণ করেছে। এই উদ্যোগ নিছক রাজনৈতিক কৌশল অতিক্রম করেছে। এটি মুসলিমবিশ্বের সাথে সংযোগ স্থাপনের একটি মানবিক সংকটকে প্রতিফলিত করে, জোর দিয়েছিলো যে সংঘাতের পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি অর্জন করা যেতে পারে। তাঁর নির্দেশনায় বাংলাদেশি শ্রম রপ্তানি বিকাশ লাভ করে। বিশ্বের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের যাতায়াতের পথ সুগম করেন শহীদ জিয়া। আমাদের কর্মীদের দক্ষতা ও স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করে, যা কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই ঘটায়নি বরং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সুনামও উন্নীত হয়েছে।
মুসলিমবিশ্বের দেশগুলোর মধ্যকার বিবাদ ঘুচিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসী দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে শহীদ জিয়া ছিলেন অন্যতম এবং এই মানসে তিনি বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সফর করেন। ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি তিনি জোরালোভাবে সমর্থন করতেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ইয়াসির আরাফাতের স্বাধীনতাসংগ্রামের সবিশেষ তাৎপর্য তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ইসলামি সংহতি উন্নয়নে রপ্তানিকারক ইসলামি দেশগুলোকে তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে অধিক সুবিধা দানের ব্যাপারে তিনি প্রস্তাব রেখেছিলেন, যদিও তাতে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবু আরব দেশগুলো সাহায্যের মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিলো, তবে সেটা তেলের দাম কমিয়ে নয়। মিসর, লিবিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া ও আফগানিস্তানের তৎকালীন ঘটনাবলি সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন এবং ইসলামি সম্মেলন সংস্থার কাঠামোর মধ্যে সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে এর সমাধান করতে চেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভূমিকার কারণেই মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো এবং ইসলামি সম্মেলন সংস্থার কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করা হয়েছিলো। এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান। বাংলাদেশের এই ভূমিকার কারণেই বাংলাদেশ ১৫ সদস্যবিশিষ্ট জেরুজালেম কমিটি, ৬ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের জেরুজালেম কমিটি, সদস্যবিশিষ্ট জেরুজালেম কমিটি, ৩ সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটি এবং ১ সদস্যদের ইরান-ইরাক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো।
তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ঢাকায় ইসলামি শান্তি কমিটির বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তটিও মুসলিমবিশ্বের স্বার্থে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানেরই কৃতজ্ঞ স্বীকৃতি। মুসলিমবিশ্বের ঐক্য, সংহতি ও উন্নতি আনয়নে, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা সমাধানে, ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধের জন্য শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি যে অবদান রেখে গিয়েছেন, তা চিরকাল মুসলিমবিশ্বের ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায় হয়ে থাকবে। আন্তর্জাতিক ইস্যুর মতো রিজিওনাল বা আঞ্চলিক ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার, ইতিবাচক ও বাস্তবভিত্তিক।
বিশেষ করে দক্ষিণের ৭টি দরিদ্র দেশের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক টানাপড়েন তাঁকে ব্যথিত করে। তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন, এই অঞ্চলের দেশগুলো পারস্পরিক বৈরিতা বিদ্বেষ ও সংঘাতে তাঁদের যে বিপুল শক্তি ও সম্পদের অপচয় ঘটাচ্ছে, তা যদি কারো সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়নের স্বার্থে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে, তাহলে তাঁদের ১০০ কোটি হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ত্বরান্বিত হবে। তিনি আরো উপলব্ধি করেছিলেন, পৃথিবীর সব অঞ্চলেই প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা বিদ্যমান, শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নেই। তাই তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার বাতাবরণ সৃষ্টিতে উদ্যোগী ছিলেন।
শহীদ জিয়ার একটি 'দর্শন' ছিল। সার্ক বা দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতার যে স্বপ্ন তিনি সেদিন দেখেছিলেন, প্রথমে কেউ তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু শহীদ জিয়া তাতে আদৌ হতোদ্যম হননি। শত বৈরিতা সত্ত্বেও তিনি বললেন, ফ্রান্স আর ব্রিটেন বা বন ও প্যারিস যদি একযোগে কাজ করতে পারে, তাহলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান বা মালদ্বীপই বা কেন একসাথে বসতে পারবে না। এক হয়ে নিজেদের অভিন্ন সমস্যা দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নের মোকাবেলায় ব্রতী হতে পারে।
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠাকল্পে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান/সরকারপ্রধানদের শীর্ষ বৈঠক আহ্বানের পূর্বে জিয়াউর র সহযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সম্পর্কে যেমন ভেবেছিলেন, তেমনি ১৯৭৮- ১৯৮০ সালের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে এই প্রত্যয়কে দৃঢ় করেন এবং ব্যক্তিগত পত্র ও দূত পর্যায়ে ভাবের আদান- প্রদান করে দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতামূলক একটি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সব মহলকে অবহিত করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে একটি নতুন পরিচয় তৈরি করতে পেরেছে, যা বাংলাদেশের জন্য সম্মানের।
শহীদ জিয়ার আমলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত হয়। তাঁর নেতৃত্ব, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার এক নতুন যুগের সূচনা করে, বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে একটি গৌরবময় স্বীকৃতি এনে দেয় । এই সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক অগ্রগতি আমাদের আত্মসম্মান ও সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রেখে আমাদের জাতির জন্য একটি নতুন স্বপ্নকে প্রজ্বলিত করেছিলো। আজও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের অনুপ্রাণিত করে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার ভিত্তিতে একসাথে এগিয়ে যেতে।
লেখক: মাহবুব নাহিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সাবরিনা/শহীদ