
২৬ মার্চ ২০২৫ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্তি
২৬ মার্চ ২০২৫ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পূর্তি। কিছুদিন আগেও আমরা বলতাম একটি দেশের জন্য স্বাধীনতার ২০-৩০ কিংবা ৪০ বছর এমন কিছু নয়। কিন্তু একটি দেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর অনেক বড় কিছু। বিশেষত পৃথিবী যে দুর্নিবার গতিতে এগোচ্ছে তাতে করে আমাদের স্বাধীনতাকে এখন আর নতুন ভাবার কোনো অবকাশ আছে বলে মনে করি না। একটি বিশাল জনসংখ্যা নিয়ে যে বাংলাদেশ, তার অগ্রগতি হতে হবে আরও দুর্বার, সুনিশ্চিত।
বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনা উঠলে একটি বিষয় অনেক গুণীজনই উল্লেখ করেন সেটি হচ্ছে, বাঙালি মাথা নোয়ানোর জাতি নয়। তাদের চলার পথে বারংবার বাধা এসেছে। তারা সেই বাধা উড়িয়ে দিয়ে সামনে এগিয়েছে। বাংলাদেশ সম্ভবত উপমহাদেশের একমাত্র দেশ যারা ব্রিটিশদের হারিয়েছে। হারিয়েছে পাকিস্তানকে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা প্রবল পরাক্রমশালী রাষ্ট্র ভারতকেও হারিয়েছে। যেমন- জিয়াউর রহমান নিজে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু দু’দফায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন।
প্রথমত, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়ত, যখন তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে নিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে দৃঢ়কণ্ঠে অনুরোধ করেন। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমাদের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের কেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া দরকার ছিল? ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর ভালোই তো ছিলাম আমরা। একটি বড় রাষ্ট্র, শক্তিশালী সমাজ হিসেবে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
তবে আমরা জানি, পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশকে কখনই তাদের প্রাপ্য মর্যাদা বুঝিয়ে দেয়নি। বাংলাদশের পাটশিল্প থেকে যে আয় হতো তার সিংহভাগ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। ইসলামাবাদকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সুন্দর শহর। আর এটি সবাই জানে যে, ইসলামাবাদ তৈরিতে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তার সিংহভাগই ছিল পূর্ব পাকিস্তানিদের ঘামে ভেজা আয়ের টাকা। যেটি গায়ের জোরে পাকিস্তানি শাসকরা নিজেদের উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে।
পাকিস্তানিরা যদি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য না করত, তাহলে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ভারত ভাগের পর থেকেই আসলে এটি পরিষ্কার ছিল ভারতের মতো বিশাল রাষ্ট্রের দুভাগে দুটি দেশ কোনো বাস্তব সমাধান নয়।
১৯৪৭ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎ চন্দ্র বসু একসঙ্গে বাংলার স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা ‘বৃহৎ বাংলা পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত। তারা চেয়েছিলেন, ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত না হয়ে বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠুক। এ ধারণার পেছনে ছিল একাধিক কারণ। প্রথমত, বাংলাকে দ্বিখ-িত করা হলে হিন্দু-মুসলমান সংঘাত বাড়বে বলে আশঙ্কা ছিল।
১৯৪৬ সালের কলকাতা এবং নোয়াখালীর দাঙ্গার নির্মম অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা গিয়েছিল, সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাংলার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে। সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু মনে করতেন, যদি বাংলা একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হয়, তবে এই জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা অনেকাংশে কমে যাবে। দ্বিতীয়ত, বাংলা ছিল একটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের শক্ত ভিতের কারণে এটি আত্মনির্ভরশীল হতে পারত।
তারা যুক্তি দিয়েছিলেন, একটি স্বাধীন বাংলা তার নিজস্ব সম্পদ ও বন্দর ব্যবহার করে শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে। তৃতীয়ত, বাংলার স্বকীয় ভাষা ও সংস্কৃতি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ কারণে অনেক বাঙালি নেতা চেয়েছিলেন বাংলা একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক, যেখানে ধর্মের চেয়ে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর বিরোধিতা করে।
কারণ, তারা মনে করত, এটি ভারতের অখ-তার জন্য হুমকি হতে পারে। বিশেষ করে, সর্দার প্যাটেল ও জওহরলাল নেহরু এ পরিকল্পনার বিপক্ষে ছিলেন। তারা আশঙ্কা করতেন, স্বাধীন বাংলা হয়তো পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে উঠতে পারে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে অথবা এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে টিকে থাকতে পারবে না। অপরদিকে মুসলিম লিগের ভেতরেও এ প্রস্তাবের ব্যাপারে মতবিরোধ ছিল।
যদিও সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মুসলিম লিগের নেতা, তবু মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি শুরুতে কিছুটা আগ্রহ দেখালেও পরে বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। কারণ, এতে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল।
ব্রিটিশ সরকারও এ পরিকল্পনা সমর্থন করেনি। লর্ড মাউন্টব্যাটেন দ্রুত ভারত ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সরল বিভাজন করাকেই অগ্রাধিকার দেন। ব্রিটিশদের আশঙ্কা ছিল, স্বাধীন বাংলা একটি দুর্বল রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে, যা ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া সাধারণ জনগণের মধ্যে এ পরিকল্পনা নিয়ে স্পষ্ট সমর্থন দেখা যায়নি।
হিন্দু সমাজের অনেক নেতা, বিশেষ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্বাধীন বাংলার বিপক্ষে ছিলেন। তারা মনে করতেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলায় হিন্দুদের অধিকার ক্ষুণœ হতে পারে। অন্যদিকে, অনেক মুসলমান মনে করতেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হলে তারা নিরাপদ থাকবে এবং ধর্মীয়ভাবে সুবিধা পাবে। এ সব রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও কূটনৈতিক জটিলতার কারণে অবিভক্ত বা বৃহৎ বাংলা বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ সরকার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দেশ ভাগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়, যেখানে বাংলাকে দুটি অংশে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৫ আগস্ট ১৯৪৭ সালে বাংলা দ্বিখ-িত হয় এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, যা পরে ১৯৭১ সালে পরিণত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে। অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার ফলে বাংলার জনগণকে বিভক্তির যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ ভারতবর্ষের অংশ হয়ে ওঠে, অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অধীনে চলে যায়। কিন্তু ইতিহাসের গতিপথ পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয় এবং ১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গ সশস্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়, যা অনেকটাই ১৯৪৭ সালের স্বাধীন বাংলার ধারণার পুনর্জন্ম হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আমাদের এটিও বুঝতে হবে যে, শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সেই সময়ে কী ছিল? ১৯৪৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমান তখনো তরুণ রাজনৈতিক কর্মী এবং ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি মূলত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন এবং যুক্ত ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লিগের রাজনীতির সঙ্গে। সেই সময়ে অবিভক্ত বাংলা পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি তার কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। তবে তিনি সামগ্রিকভাবে তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বসু যখন স্বাধীন বাংলা গঠনের প্রস্তাব দেন, তখন শেখ মুজিবের প্রধান লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান গঠনে পূর্ব বাংলার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা। তিনি এবং তার মতো তরুণ মুসলিম লীগ নেতারা বিশ্বাস করতেন যে, পূর্ব বাংলা যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়, তাহলে সেখানে হিন্দুদের প্রভাব বেশি থাকবে এবং মুসলমানদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে, ১৯৪৬ সালের কলকাতা এবং নোয়াখালী দাঙ্গার রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতা মুসলমানদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তৈরি করেছিল।
শেখ মুজিব এ প্রেক্ষাপটে মনে করতেন যে, পাকিস্তানের অংশ হলে বরং পূর্ব বাংলার মুসলমানরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে নিরাপদ থাকবে। তাছাড়া তিনি তখনো মুসলিম লিগ এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। জিন্নাহ পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন এবং শেখ মুজিবসহ অন্য মুসলিম লীগ নেতারা সেটির পক্ষে ছিলেন।
তারা মনে করতেন, ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্তি হলে মুসলমানরা তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে, যেখানে তাদের অধিকার নিশ্চিত থাকবে। ফলে অবিভক্ত বাংলা গঠনের পরিকল্পনাকে শেখ মুজিবুর রহমান সেভাবে সমর্থন করেননি।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্ব অংশে চলে আসেন এবং ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি আস্থা হারাতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন, পূর্ব বাংলার মানুষ রাজনৈতিকভাবে উপেক্ষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হচ্ছে। ১৯৫০-এর দশকে তিনি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন, যেখানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি তোলেন।
এখান থেকেই শুরু হয় তার পাকিস্তানপন্থী অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে যাত্রা। পরবর্তী দুই দশকের রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলার আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। শেষ পর্যন্ত, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘটে। ইতিহাসের এই গতিপথে তিনি সেই স্বতন্ত্র বাঙালি রাষ্ট্রের স্থপতি হন, যা ১৯৪৭ সালের অবিভক্ত বাংলার এক ভিন্ন বাস্তবায়ন বলা যেতে পারে।
স্বাধীনতা দিবসে এই সময়ে সামনের দিকে এগোনোর জন্য আমাদের পিছনে ফিরে তাকানো জরুরি। আমরা অনেকেই ইতিহাস পাঠ করি না, গবেষণা করি না, এমনকি ইতিহাস থেকে শিক্ষাও নেই না। ইতিহাস থেকে পাঠ না নিলে ইতিহাস গড়া যায় না। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে এখন বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হতে হবে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেটি থেকেও আমাদের শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
মার্চ ২৩, ২০২৫
kindlejitu@gmail.com