
সিডনির মেলব্যাগ
আমরা যুদ্ধবিরোধী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বা যে কোনো দেশে যুদ্ধ মানেই মানুষের বিপদ ও মৃত্যু। সিয়াম সাধনার মাসে সিডনির বাঙালিও পালন করছেন তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব। মাঝে মাঝে বুক কাঁপানো যুদ্ধের খবর আর রক্তপাত আমাদের ঘুম কেড়ে নিলেও সবার মনে ঈদের বাতাস বইতে শুরু করেছে। প্রায়ই নানাবিধ কর্মকা- নানা মেলা উৎসবের প্রস্তুতি বলে দেয় যে, সময় ঘনিয়ে আসছে।
খেয়াল করে দেখবেন বিশ্ব বদলে গেছে। আগে দুনিয়ার যে কোনো জায়গায় একটা বোমা ফাটলেই মানুষ নড়েচড়ে বসত। খবর হয়ে যেত সারা পৃথিবীতে। এখন আর তেমন হয় না। গাজায় আক্রান্ত সভ্যতা ও মানুষের জীবন। যারা মারছে তারা বেপরোয়া। অথচ মানুষের মনে আফসোস বা দ্রোহ থাকলেও আগের মতো তা সংঘবদ্ধ নয়। হবে কিভাবে? আপনাদের মনে থাকতে পারে একসময় বিশ্বের নেতাদের মানুষ সমীহ করত।
যখন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বে ছিলেন রিগান, ফোর্ড বা বিল ক্লিনটন- তখন আমেরিকার চেহারা ছিল অন্য রকমের। যখন রাশিয়ায় লেনিন বা ক্রুশ্চেভ বা ব্রেজনেভ ছিলেন, তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মানুষের আশার প্রতীক। সে রাশিয়া এখন ইউক্রেনে যুদ্ধ করছে। দিনের পর দিন চলছে সে লড়াই। সম্প্রতি ইউক্রেনের নেতাকে হোয়াইট হাউসে অপদস্ত হতে দেখলাম। অথচ দু-একটা বুদবুদ নিউজের পর তার আর কোনো খবর নেই।
কী হচ্ছে দুনিয়ায়? এমনকি আমাদের দেশেও আমরা দেখি হইচই আর অশান্তি যেন লেগেই আছে। পরিবর্তনের হাওয়া কতটা কি করতে পারছে, তার চাইতে বড় হয়ে উঠেছে উত্তেজনা। মানুষ কি তবে উত্তেজনা ভালো বাসছে? সামাজিক মিডিয়ার ভূমিকা ভুললে চলবে না। সামাজিক মিডিয়া একদিকে যেমন আমাদের ভালো করছে, আরেকদিকে উত্তেজনা প্রসারেও ভূমিকা রাখছে ব্যাপক। কোথাও কিছু হলেই সঙ্গে সঙ্গে তা চলে আসছে চোখের সামনে।
যাচাই-বাছাই বাদ দিয়ে মানুষ দলে দলে ভাগ হয়ে লড়াই করছে এসব নিয়ে। অথচ আমরা জানতাম মিডিয়া মানে সম্পাদিত কোনো নিউজ বা ভিউজ। যাতে সত্য থাকবে কিন্তু অতিরঞ্জন থাকবে না। যা দিনশেষে শান্তি আর সমঝোতার কথা বলবে। সেটা এখন দুনিয়ার প্রায় কোথাও নেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, একজন আক্রান্ত হলে বাকি দশজন মজা নিয়ে সেটা ভিডিও করে। কেউ আগ বাড়িয়ে ঝগড়া থামায় না।
সাইকোলজিস্ট বা মনস্তত্ত্ববিদরা বলছেন, এটা আমাদের রোগে পরিণত হতে চলেছে। এত আক্রমণ উত্তেজনা আর হিংসার বুকে দাঁড়িয়ে তা দেখার পর মানুষ সুস্থ থাকবে কীভাবে? আমরা মনে করি আমাদের দেশের তারুণ্য বা শিশু কিশোরদের মন মানসিকতা পড়ার কেউ নেই যেন। যেমন- এসব দেশে কাউন্সিলিং হয়। কাউন্সিলিং বাধ্যতামূলকও বটে। সরকার বা সামাজিক সংস্থাগুলো এ কাজ করে। লাখ লাখ ডলার খরচ করে সরকার বা প্রতিষ্ঠানগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিধান করে। হয়তো জনবহুল দেশে তা অসম্ভব। কিন্তু প্রচেষ্টা তো থাকতে হবে।
যুদ্ধ মানুষের মনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তা ভয়াবহ। ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম আমি। যুদ্ধের এত বছর পরও বহু মানুষ ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। লাওস দেশে বয়োবৃদ্ধ প্রজন্ম প্রায় নেই। আছে চল্লিশ বা তার কিছু বেশি বয়সী মানুষ। অথচ মানুষের আয়ু এর চেয়ে বেশি। এই যে শূন্যতা তা আর যাই হোক, কোনো সমাজকে ভালোভাবে এগোতে দেয় না। আমরা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন একটি দেশ।
এই সেদিনও লড়াই করতে হয়েছিল। এরপর আর কোনো লড়াই আমরা দেখতে চাই না। চাই সবার ভালো থাকা। এই ভালো থাকাটা এখন একক কোনো দেশ বা সমাজের ওপর নির্ভর করে না। গ্লোবাল ভিলেজ নামে যে কনসেপ্ট, তা আমি প্রথম পাই শ্রী অরবিন্দের দর্শনে। সে দর্শন মূলত মানুষের ভালো থাকার জন্য এক বিশ্বের স্বপ্ন। অথচ দুনিয়া এখন তার বিপরীতে।
বলছিলাম সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি সমাজের কথা। তারা সাধনা ও সংযমের পাশাপাশি যুদ্ধ বিরোধিতায় উন্মুখ। যার যা সাধ্য তা নিয়েই সোচ্চার। কারণ, শান্তির কোনো বিকল্প হয় না। ভালোভাবে তাকালে আমরা দেখব দুনিয়ায় মূলত দুই শ্রেণির মানুষের বসবাস। এক. যারা সমৃদ্ধ উন্নত ও ধনী।
আরেকদিকে অভাব দারিদ্র্য আর হতাশায় ভোগা মানুষ। এই অসাম্য বা ভেদাভেদ মানুষকে অসুখী করে। এক সময় যখন যা খুশি দেখা যেত না, শোনা যেত না। তখন এগুলো ছিল গল্পের মতো। এখন তা চোখের সামনে দৃশ্যমান। তাই মানুষের মনে যে বিরূপতা তাকে সামাল দিতেই হবে।
উন্নত দেশগুলোতে রয়েছে একাকিত্ব আর ভয়াবহ মানসিক সংকট। তাদের খাদ্য আছে, কিন্তু সন্তোষ বা সন্তুষ্টি নেই। অন্য প্রান্তে খাদ্য নেই চাহিদা আছে জোগান নেই। সাম্যের অভাব। এভাবে আর যাই হোক সভ্যতা এগোতে পারে না। সে কারণেই বিশ্বব্যাপী শান্তি আর সহযোগিতা দরকার।
বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী প্রবাসী। তারা সাধ্যমতো দেশে টাকা পয়সা পাঠায়। কিন্তু তারা ঠিক জানে না এর ব্যবহার বা উপকারিতা কি? বদলে যাওয়া দেশ ও সরকারের দায়িত্ব এসব জানানো। দেশের প্রকৃত সামাজিক অবস্থা তুলে ধরা।
আমরা বিশ্ববাসীর সঙ্গে চলতে চাই। এই চলমানতার জন্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি আর নৈতিকতা দরকার। এক সময় আমরা মায়ার দেশ ভালোবাসার সমাজ নামে পরিচিত ছিলাম। এখনো যে তা নেই, তা নয়। তবে তার প্রকাশ দেখি না। সহমর্মিতা আর সহাবস্থান বিদেশে যেমন সম্ভব, তেমনি দেশেও সম্ভব। সে ইতিহাস আমাদের আছে। শ্রমজীবী কর্মজীবী মানুষরা তা পালন করেন। দরকার নিয়ম আর শৃঙ্খলা। এটা কোনো কথার কথা নয়।
সারা দুনিয়ায় খামখেয়ালি আর কর্তৃত্ববাদ এমনভাবে থাবা বিস্তার করেছে যে, অনেক সময় আমরা ভুলে যাই আমরা আসলে কি চাই? মানুষের মনে যে শান্তি আর সৌহার্দ্য মূলত তার নতুন নাম মানবিকতা। একটি মানবিক পৃথিবী মানেই মানুষ দেশে দেশে সমাজে সমাজে নিরাপদ। এই নিরাপত্তার কারণেই বিভিন্ন নিয়ম আর মতবাদের জন্ম হয়েছে। আধুনিকতার নামে এখন যা দেখি তা অনেক সময় মানা কঠিন।