
স্বাধীনতা দিবসটি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের
স্বাধীনতা দিবসটি বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে আমরা জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। স্যার সৈয়দ আহমদ, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ এ অঞ্চলের অনেকেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন; কিন্তু বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি ছিলেন শঙ্কাহীন, অবিচল। তিনি এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়নে রেখেছেন অনবদ্য ভূমিকা।
অধ্যাপক জোসেফ ক্যাম্পবেলের মতে, ‘তিনি নায়ক, তিনি তার নিজ সত্তার থেকে বড় কিছু রেখে যান।’ বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ধারাবাহিক সংগ্রামে শেখ মুজিব এমন একজন ব্যক্তিত্ব ও মোহনীয় যার নেতৃত্ব, যিনি এই অঞ্চলের মানুষকে সম্পৃক্ত করে স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Observer পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক Cyril Dunn লিখেছেন ‘ওহ the thousand year history of Bengali, Sheikh Mujib is her only leader who has, in terms of blood, race, language, culture and birth been a full blooded Bengali. His physical stature was immense. His voice was redolent of thunder. His charisma worked magic on people. The courage and charm that flowed from made him a unique superman in these times.’
১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘ভারত স্বাধীনতা আইন’ পাস করার মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটো রাষ্ট্রের জন্ম নেয়। এতে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে চিহ্নিত করে পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনামলে এতদঞ্চলের মানুষকে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও চরম বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়।
অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে শোষণ-দমন-নিপীডনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষকে দাবিয়ে রাখার সর্বাত্মক প্রয়াস চালানো হয়। ফলে এই অঞ্চলের মানুষের মনে পাকিস্তানিদের অপশাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ জমাট বাঁধতে শুরু করে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ মুজিবকে বহুবার কারাবরণ ও অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি কখনো শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপোস করেননি।
ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রামের এক পর্যায়ে শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ছয় দফা ঘোষণা, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান এবং ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা নয়, দেশকে মার্চেই যেন স্বাধীন করে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালে জুলাই মাসের South Asian জবারবি তে উল্লেখ করা হয়- ‘When the police and servants joined judges in pledging support for Mujib, a defect transfer of power taken place inside Bangladesh and it had happened with a week of Yahi“aÕs decision. During next three weeks, Mujib's house became in effect the secretariat of Bangladesh.
অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বিষয়টি মীমাংসার জন্য আলোচনা চললেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ ১৯৭১ ঘুমন্ত বাঙালি জাতির ওপর অপারেশন ক্র্যাক ডাউন শুরু করলে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণাটি সর্বপ্রথম ট্রান্সমিটারের সহায়তায় চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন। ঘোষণাটি ছিল : This may be my last message, today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours.
ঘোষণাটি চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস-এ মুদ্রিত করা হয় এবং ২৬ মার্চ প্রত্যুষে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিলি বণ্টন এবং একইসঙ্গে মাইকিংও করা হয়। তৎসময়ের চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন, উক্ত ঘোষণাপত্রটি একজন সামরিক অফিসার দ্বারা প্রচার করা হলে মুক্তিযুদ্ধের গতি আরও বেগমান হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথমে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন রফিক এবং পরে মেজর জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
ঐদিনই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া প্রথমে নিজের নামে এবং পরবর্তীতে সংশোধন করে মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। এক সাগর রক্ত ও অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
এটা সত্য যে, একটি জাতি শুধু স্বাধীন হলেই মুক্তি সুনিশ্চিত হয় না; বরং মুক্তির জন্য প্রজন্ম থেকে প্রজামন্তরে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। এতে অনেক বাধা-বিপত্তি আসতে পারে, তবে সেসবই তাকে ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনাসহ সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সুনিশ্চিত করে যেদিন এদেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, আশ্রয় নিশ্চিত হবে ও বাসস্থান সুনিশ্চিত হবে; মন-প্রাণে দেশের মানুষ বলবে আমরা ভালো আছি, সুখে-শান্তিতে আছি, সেদিন এই দেশটির স্বাধীনতা সার্থক অর্থবহ হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব অতুলনীয়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে শেষ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের নামের সঙ্গে শেখ মুজিবের নামটি উচ্চারিত হবে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ ১৬ আগস্ট ২০১৯ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্ববন্ধু (Friend of the world) উপাধিতে ভূষিত করেছে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মতপার্থক্য থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এমনকি, আদর্শগত বৈসাদৃশ্য থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বিভিন্ন মত ও আদর্শের প্রতি আমাদের যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ-পরমতসহিষ্ণুতা বজায় থাকে এবং দেশের স্বার্থে হিংসা-প্রতিহিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করে দল-মত নির্বিশেষে আমরা যদি অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হই, তাহলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ একদিন পৃথিবীর বুকে বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, উন্নত-সমৃদ্ধ-মানবিক ও ন্যায্যতাভিত্তিক মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এবারের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে এটাই হোক বাঙালি জাতির দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়