
ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ
বছরে দুটি ঈদ। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। ঈদ মানে খুশির জোয়ার, আনন্দের উচ্ছ্বাস। একে অপরের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে মেতে ওঠা আনন্দে। রমজান প্রায় শেষ লগ্নে। আর কিছুদিন পরই ঈদুল ফিতরের ছুটিতে মানুষ নাড়ির টানে বাড়ির পানে ছুটবে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ঈদ মানেই তো বাড়ি ফেরার তাগাদা, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দ অনুভব করার তীব্র আকাক্সক্ষা।
পরিবারে শান্তির খোঁজে আসা কর্মব্যস্ত শহরকে ছেড়ে প্রিয়জনদের কাছে ছুটে যাওয়ার এই যাত্রায় থাকে উত্তেজনা, আবেগ ও উচ্ছ্বাস। কারণ, বাংলাদেশে দুই ঈদে অন্যান্য ছুটির তুলনায় একটু বেশিই ছুটি পেয়ে থাকে। এই একটু বেশি পাওয়ায় আনন্দের মাত্রাটা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু এই আনন্দযাত্রা যেন মৃত্যুপরিণত না হয়, সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। আর এ সময়ের দুর্ঘটনা একটা পরিবারের ঈদের আনন্দকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা ও সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক।
ঈদের ছুটিতে দেশের সড়ক-মহাসড়ক, নৌপথ ও রেলপথে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, তাতে প্রাণহানি, আহত ও দুর্ঘটনার সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায় প্রতি বছর। এই দুই ঈদের মৌসুমে সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেখা যায়, ঈদযাত্রায় শত শত মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা এবং দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র। অথচ একটু পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা ও সচেতন থাকলে এই দুর্ঘটনাগুলো এড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশে প্রতিটি ঈদের সময় রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্য বড় শহরগুলো থেকে কোটি মানুষ গ্রামে ফিরে যেতে চায়, বাড়িতে ফিরতে চায় তাড়াতাড়ি। এ জন্য দেখা যায় সড়ক, রেল ও নৌপথে যাত্রীদের চাপ বেড়ে যায় বহুগুণ। কিন্তু সামগ্রিক পরিবহন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও পরিকল্পনার অভাবে এই ভ্রমণ যাত্রা হয়ে ওঠে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অসহনীয় কষ্টকর। যেটা দেশের জন্য খুবই হতাশার। এই যাত্রা ঝুঁকিপূর্ণ ও কষ্টকর হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু কারণও থাকে। এগুলো থেকে সাবধান হওয়া সবার জন্য কর্তব্য।
ঈদে যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ থাকায় দেখা যায়, গাড়ির মধ্যে বা পরিবহনের মধ্যে স্বাভাবিক যে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে থাকে। যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে। সেই সঙ্গে দেখা যায় গাড়ির ফিটনেস ঠিক নেই। বিশেষ করে এ সময়টাতে দীর্ঘদিন গ্যারেজে পরে থাকা আনফিট গাড়িও রাস্তায় নামিয়ে দেয় শুধু একটু বেশি টাকা পাওয়ার জন্য।
সামান্য লোভ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। মানুষের আনন্দকে মাটি করে দেয়। তার ওপরে গাড়ির চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায় একটু বেশি ইনকাম করার জন্য। এক্সট্রা ট্রিপ পাওয়ার লোভ থেকে যাত্রীদের কথা চিন্তা না করে অনেক স্পিডে গাড়ি চালায়। তার ওপর দেখা যায়, চালকরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়েই গাড়ি চালায়। যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে বেশি। বাড়ি ফেরার অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
মহাসড়কের অবস্থা, অতিরিক্ত যানবাহন, অবৈধ পার্কিং, রাস্তার পাশে দোকান বসানো, ওভারটেকিংসহ নানা কারণে তৈরি হয় যানজট। ঈদের সময় দেশের মহাসড়কগুলোতে ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে আটকে থেকে যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন। দেশের সড়কগুলোতে ট্রাফিক আইন মানার প্রবণতা অত্যন্ত কম। চালকদের অসচেতনতা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা, ওভারটেকিং ও ট্রাফিক পুলিশের কার্যকর নজরদারির অভাবে ঈদের সময় দুর্ঘটনার মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যু হয় এবং হাজারো মানুষ আহত হন। ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে ১৪ দিনের ঈদযাত্রায় ৪৮৪টি দুর্ঘটনায় ৫১০ জন নিহত ও ৭০০ জনের বেশি আহত হন।২০২২ সালে একই সময়ে ৩৭২টি দুর্ঘটনায় ৪১৭ জন নিহত হন। ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ বেশি থাকে। এই সময়ে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে বেশি।
পরিসংখ্যান বলছে, ঈদের সময় সড়কপথ এক অঘোষিত মরণ ফাঁদে পরিণত হয়। এত বছরেও এই সমস্যার কার্যকর সমাধান হয়নি। ঈদ যাত্রা যাতে জীবনের শেষ যাত্রা না হয়, সেজন্য সকলে মিলে কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে সকলে মিলে সেগুলোকে রূপ দিতে হবে বাস্তবে। শুধু সরকারের একার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিলে যথেষ্ট কল্যাণকর ও কার্যকরী হবে না। চালক, যাত্রী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারসহ সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
ঈদে যথাসম্ভব গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে এ সময়ের যাত্রীর চাপ সামলানো যায় । এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, পরিবহনগুলোর যেন ফিটনেস ঠিক থাকে। আনফিট গাড়ি যাতে রাস্তায় না উঠতে পারে, সেজন্য আইনকে সজাগ থাকতে হবে। গাড়ির চালকরা যাতে ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলে, এটা নিশ্চিত করা আবশ্যক। যারা নিয়ম ভঙ্গ করবে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
পরিবহন মালিকরা ড্রাইভারদের যথেষ্ট বিশ্রাম নেওয়া সুযোগ দেবেন। ড্রাইভারদের অন্য গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর মন মানসিকতার দূর করতে হবে। এর পাশাপাশি স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালাতে হবে। যাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা থাকতে হবে, তারা যেন নির্দিষ্ট আসন পূরণের পর ওই পরিবহনে না ওঠেন।
দেশবাসীর কাছে দুর্ঘটনা নিছক একটা সংখ্যা হলেও যারা এই দুর্ঘটনা শিকার হোন, তাদের পরিবারের কাছে একটি স্বপ্নভঙ্গ, অপূরণীয় ক্ষতি। তাদের ঈদটাও মাটি হয়ে যায়। আমরা এমন ঈদ প্রত্যাশা করি না, যে ঈদে কোনো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঈদের আনন্দটা তখনই পূর্ণতা লাভ করবে, যখন পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে সবাই এবং ঈদ পালন করতে আনন্দের সঙ্গে। সবার ঈদ হোক আনন্দ, খুশির এবং নিরাপদ সড়কে হোক বাড়ি ফেরা।