
আমরা পবিত্র রমজান আর মহিমান্বিত মার্চের রক্তঝরা সময়গুলো পার করছি। সামনে কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। জাগতিক এক পবিত্রতম মাহাত্ম্যে রমজানের যে অপার মহিমা তা যেন সম্মিলিত এক অনুভবের দ্যোতনা।
আবার রক্তঝরা মার্চ যেন স্মরণ করিয়ে দেয় কত ক্ষত-বিক্ষত দগ্ধতার নিদারুণ চিত্র। আর ২৫ মার্চ তেমন আগুনের ফুলকিতে কালো আঁধারের এক অবিমিশ্র দাবানল। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চের অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে যে হিংস্র হত্যাযজ্ঞে বাঙালি নিধনে উন্মত্ত হয়েছিল তা বিশ্ব ইতিহাসেরও দগদগে ক্ষতচিহ্ন।
পরাক্রমশালী হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞও যেন ম্লান হওয়ার দুর্দশা। ২৫ মার্চ আজও বাঙালির জীবন আর ইতিহাসের অমাবস্যার নিবিড় কালোছায়া। ভোলা যায় না ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল মার্চের রক্তাক্ত পিচ্ছিল পথকে।
স্বাধীনতা অর্জনের ৫৪ বছর পার হওয়ার মহাসন্ধিক্ষণে স্মৃতির মিনারে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মতো ২৫ মার্চের রক্তে রঞ্জিত কালরাত্রিই সবার আগে সামনে এসে দাঁড়ায়। ভীতসন্ত্রস্ত দেশ ও জাতি তখন দিশাহারা, দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য।
শুধু কি তাই-ই, আধুনিক সমরাঙ্গণে অভিজ্ঞ সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামনে তখন থর থর কম্পমান নিরস্ত্র আপামর মানুষ। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা দিয়েছে ২৫ মার্চ রাতে এক মিনিট সারাদেশ অন্ধকার থাকবে।
শুধু কি কালরাত্রি? বলা হচ্ছে নিরীহ বাঙালির ওপর সশস্ত্র হামলায় গণহত্যার মতো অমানবিক এক জঘন্য বাতাবরণ। যা ইতিহাসের কালো দাগ হয়ে আছে। মোছা তো যাবেই না। ভুলে যাওয়া ততোধিক কঠিন। ইতোমধ্যে বর্তমান সরকার কর্তৃক ঘোষিত হয়েছে ২৫ মার্চের কালরাত্রির প্রথম প্রহরে সারাদেশ এক মিনিট অন্ধকারে থাকবে।
কোনো ধরনের আনন্দ উৎসব কিংবা আলোকসজ্জা থেকে দেশ ও মানুষ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবে। তবে জরুরি কিছু জাতীয় স্থাপনায় এমন নিষেধাজ্ঞা শিথিলযোগ্য। দিবসটির যথার্থ মর্যাদা সুরক্ষায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা পৃথক পৃথক বাণীতে এর তাৎপর্য উল্লেখ করবেন।
সারাদেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গণহত্যা দিবসের স্মৃতিচারণ সঙ্গে আলোচনা সভায় তাৎপর্য তুলে ধরা হবে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নির্বিচারে বাঙালি নিধনসহ সংশ্লিষ্ট যুদ্ধের ওপর সেমিনার আয়োজন দিবসটির বহুমাত্রিক কর্মসূচির অনন্য প্রতিপাদ্য বিষয়। একযোগে রাজধানীসহ সারাদেশে এমন অনুষ্ঠান লাগাতারভাবে চলার নির্দেশ এসেছে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে।
দেশের বিভিন্ন নগর কর্তৃপক্ষ এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ওপর আলোকচিত্র ও প্রামাণ্য চিত্রের প্রদর্শন করা হবে। জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্র বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে ২৫ মার্চে জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে।
নামাজের পর বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ দোয়া মাহফিলেরও আয়োজন করা হবে।
দিবসটি শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্ব নয়। বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে ২৫ মার্চের যে ভয়াবহ নৃশংসতা যা বিশ্বের জঘন্যতম অত্যাচারকেও ছাড়িয়ে যায়। ২৫ মার্চের গণহত্যার ধ্বংসযজ্ঞ ইতিহাসের এক রক্তে প্লাবিত নিষ্ঠুরতম অধ্যায়।
২৫ মার্চের আগেই পাকিস্তানি জঙ্গি সামরিক বাহিনী অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে দুর্বল হওয়ার অবস্থায়। আর বীর বাঙালি স্বাধীনতার মহামন্ত্রে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেন অকুণ্ঠিত, দ্বিধাহীন। ঐক্যবদ্ধ জাতি মরণপণ যে কোনো সংগ্রামী অভিযাত্রাকে আঙ্গিলন করে সম্মুখ সারিতে দেদিপ্যমান।
আর সুচতুর পাকিস্তানি সেনা এবং দেশের অবাঙালিরা বিভিন্নভাবে একজোট হয়ে নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের উন্মত্ততায় আগ্রাসী মনোবৃত্তিরই করুণ রাত্রি ২৫ মার্চের অন্ধকারময় দুনিয়া।
তিন শতাধিক নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয় সৈয়দপুরের বিভিন্ন স্থানে। আবার নতুন করে বাঙালি নিধন অভিযানে ২৫ মার্চ যেন রক্তস্নাত এক লোহিত সাগর। চারদিক থেকে আওয়াজ উঠতে থাকে বীর বাঙালিকে কোনোভাবেই দাবিয়ে রাখা যাবে না।
রক্তের শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়াকু বাঙালি মরণপণ সংগ্রামে আত্মাহুতি দিতেও পেছনের দিকে তাকাবে না। সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীন মাতৃভূমির চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল।
সারা বাংলাদেশের সব অঞ্চলই মুক্তিকামি বাঙালির সদর্প পদচারণায় যেন কেঁপে ওঠে। কোনোভাবে মাথা না নোয়ানোর দৃঢ়, তৃপ্ত প্রত্যয়ে। সঙ্গত কারণে মৃত্যুও নিশ্চিতভাবে আলিঙ্গন করতে হয়েছে। বেতার এবং টিভি কেন্দ্র ও পাকিস্তানি সামারিক বাহিনীর ঘেরাটোপে আবদ্ধ যেন রুদ্ধতার জালে আটকে যাওয়া।
স্বাধীন বাংলার কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন হানাদার বাহিনীর আগ্রাসী আক্রমণকে প্রতিহত করতে সম্মুখ সমরে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। যার যা সামান্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ছিল তাই দিয়ে একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর আক্রমণকে ঠেকানো কোনোভাবেই সম্ভব ছিলই না।
সেখানে প্রয়োজন ছিল আর একটি সশস্ত্র গণবিপ্লবের জাগরণ। অস্ত্রের সাঁড়াশি আক্রমণে তাও ধূলিসাত হতে সময় লাগেনি। আর ২৫ মার্চের কালরাত্রি কিভাবে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞের কঠিন বাতাবরণ তৈরি করে সেটা মানবসভ্যতার ওপর ক্ষত-বিক্ষত আঁচড় তো বটেই।
তেমন ঘন কালরাত্রিতে ঢাকার রাজপথে যে রক্তের বন্যা প্লাবিত হয় তা ঐতিহাসিক দুর্যোগের এক ক্ষত-বিক্ষত আঁধার রাত। মর্মস্পর্শী এমন দুর্বৃত্তায়ন সহজে মানা তো যায়ই না। ভোলাও ততোধিক কঠিন।
৫৪ বছরের মহা সন্ধিক্ষণে আজও বাঙালির হৃদয় রক্তস্নানে লোহিত সাগর হয়ে যাওয়া। শুধু ২৫ মার্চ নয় মাসব্যাপী বাঙালির লড়াকু অভিযাত্রা ইতিহাসের রক্তে রঞ্জিত ঢাকা আর এক মহাদুর্ভোগ স্বাধীনতাকামী বাঙালির জন্য। ২৪ বছরের পরাধীনতার শোষণ, বঞ্চনা আর গ্লানি মুছে ফেলা অত সহজসাধ্য ছিলই না।
সর্ব বাঙালির লড়াকু উদ্দীপ্ত, দুঃসাহসিক চেতনা শিকড় শিখরে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি অপেক্ষাও করতে হয়নি। সেই অগ্নিঝরা লড়াকু মার্চের ২৫ তারিখ রাতে সারাবিশ্ব মর্মান্তিকভাবে উপলব্ধি করল এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার মাটি প্লাবিত হওয়ার চরম দুর্বিষহ অবস্থা।
তবে সমৃদ্ধ ইতিহাসের স্রোতধারায় সর্ব মানুষের জাগরণ কাল ও যুগের পুনরাবৃত্তি। বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো আপামর বাঙালি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কঠিন-কঠোর শৃঙ্খল ভেদ করে বের হয়ে আসে সেটা যেন নব ইতিহাসের পরম বরমাল্য।
বীর বাঙালি তাদের কটিন, দুর্গম যাত্রাপথকে কি মাত্রায় লড়াকু অভিযাত্রায় এগিয়ে দেয় সেটাও যেন দেশ-জাতির পরম আকাক্সিক্ষত এক স্বপ্নের দুয়ার হাতের নাগালে পাওয়া। ২৫ মার্চের কালরাত্রির যে অনাকাক্সিক্ষত রক্তক্ষরণ তা যেন সৃষ্টির বেদনা আর রক্তের প্লাবনের অবিমিশ্র ধারা।
স্বাধীনতা, স্বজাত্যবোধ আত্মসম্মান আর মর্যাদায় টিকে থাকার ধারাবাহিক এক প্রক্রিয়া। উদিত স্বাধীনতার সূর্য সুরক্ষিত রাখতে অমাবস্যার অন্ধকারকে জোর কদমে হটিয়ে দিতে হবে। স্বাধীনতাকে নিত্য জয় করার মতো এক অভাবনীয় যাত্রাপথ।
তাই এমন যুদ্ধ নাকি কখনো শেষ হয় না। গত ষোলো বছরের লাগাতার অপশাসনে ব্যক্তিক ক্ষমতা, দাপট আর প্রাবল্যে সাধারণ মানুষের জীবনমন ছিল আড়ষ্ট, দুর্ভোগ, দুর্যোগে আক্রান্ত। লাগাতর অপশাসনের বদ্ধ এক ঘেরাটোপ।
সেখান থেকে জুলাইয়ের আধুনিক প্রজন্মের গণঅভ্যুত্থান ঐতিহাসিক আর এক দায়বদ্ধতা বললে অত্যুক্তি হবে না কিন্তু। যে কোনো সুদীর্ঘ দুঃশাসন সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, স্বাধীনতা সব যেন বাধাবিঘ্নতার জালে আটকেপড়া আর এক রুদ্ধতার বেষ্টনী।
উদীয়মান আধুনিক প্রজন্মের নতুন সময়ের দীপ্ত আহ্বানে বাঙালি জাতি পুনরায় জেগে ওঠা সেটাও ঐতিহাসিক বরমাল্যের পুনরাবৃত্তি।
নতুন সময়ের নব মুক্তির পালাবদলে জাতি পেল আর এক স্বাধীন সত্তায় টিকে থাকার নব আনন্দ। আনন্দ স্রোত ধারায় রক্তে রঞ্জিত ২৫ মার্চের অমাবস্যার রাতটি পুনরায় তার আবেদন নিয়ে হাজির।