
ছবি : মাইকেল লরেন্ট, এপি। ২৭ মার্চ ১৯৭১
বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আন্দোলন চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা শেষ পর্যন্ত বেছে নেয় গণহত্যার পথ। নিজ দেশের নিরীহ, নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে একতরফা যুদ্ধ ঘোষণা করে। অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে একযোগে ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু করে। এর মধ্যে পিলখানার ইপিআর (বিডিআর) হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের মূল টার্গেট। সে রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মেতে ওঠে এক পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে। এর মধ্যে নীলক্ষেতের গণহত্যাটি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।
’৭১-এর ২৫ মার্চ সকালে আলোচনা অসমাপ্ত রেখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে, সংলাপের নামে এতদিন তারা যে কালক্ষেপণ করছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলন বল প্রয়োগ করে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য সামরিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা। পাকিস্তানি সৈন্যরা এমন পৈশাচিক উন্মত্ততায় গণহত্যায় মেতে উঠবে, তা সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, রাজনৈতিক নেতারা পর্যন্ত কল্পনা করতে পারেনি।
সেদিন সন্ধ্যার পরপরই ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। পাড়া-মহল্লায় মানুষ ছোট ছোট জটলা করে কি হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। চারদিকে কানাঘুষা চলতে থাকে যে, রাতে সেনাবাহিনী নামবে। সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। আন্দোলনকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নেয়। এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে নগরবাসী ঘুমের প্রস্তুতি নেয়।
এক সময় ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে পলাশী-নীলক্ষেত-কাঁটাবন দিয়ে ট্রেন চলত। ১৯৬৬ সালে এ পথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেও ট্রেনলাইন ছিল তখনো। ট্রেনলাইনের দু’ধারে ছিল বস্তি। ঢাকা শহরের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষই এ বস্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করত। পাকিস্তানি সৈন্যরা সেদিন রাতে বস্তিবাসীকে হত্যার মাধ্যমে তাদের নৃশংস অভিযান শুরু করে। তাদের ধারণা ছিল, ইকবাল হলে গেরিলারা শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। গেরিলাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুত রয়েছে এসব বস্তিতে। এ কল্পনাপ্রসূত চিন্তা থেকে তারা বস্তিবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চালায় ইতিহাসের এক জঘন্যতম গণহত্যা।
২৫ মার্চ রাত ১১টার সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে সাঁজোয়া যানসহ শত শত পাকিস্তানি সৈন্য শাহবাগ হয়ে এসে টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তাদের দেখে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির বাঙালি সিপাইরা পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। নীলক্ষেতে এসে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথমেই ফুটপাতে রাত যাপনকারী রিক্সা, ভ্যান ও ঠেলাচালকসহ সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে একসঙ্গে জড়ো করে বসিয়ে রাখে। রাত সাড়ে ১১টার সময় ট্যাংক, কামান, মর্টার, ভারি মেশিনগানসহ আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম তারা সংকেতমূলক একটি ফায়ার করে। তারপরই শুরু হয় ভয়াবহ আক্রমণ। ট্রেসার বুলেট নিক্ষেপ করে তারা প্রথমে বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন লেগে যাওয়ায় ঘুমন্ত মানুষ বের হয়ে আসে। আর তখনই চলে ভারি মেশিনগান থেকে গুলি। নারী-পুরুষ-শিশু আত্মরক্ষার জন্য জ্ঞানশূন্য হয়ে দিগি¦দিক দৌড়াতে থাকে। এ সময় বৃষ্টির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে পড়তে থাকে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে প্রকম্পিত হয় নগরী। আগুনের লেলিহান শিখা বহুদূর থেকে দেখা যায়। আগুন নেভানোর জন্য পলাশী থেকে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি আসার চেষ্টা করে। কিন্তু গুলির মুখে ফিরে যায়।
একদিকে আগুনের লেলিহান শিখা, অন্যদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে পড়ে এসব অসহায় মানুষ রাতের আঁধারে বেঘোরে প্রাণ হারাতে থাকে। মানুষের বাঁচাও বাঁচাও করুণ আর্তিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। এ সময় কেউ কেউ নীলক্ষেতের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার দেওয়াল টপকে বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কেউ কেউ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের দেয়াল টপকে সেখানে আশ্রয় নেয়। এভাবে গভীর রাত পর্যন্ত চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। পরদিন সকাল হলে দেখা যায় গুলিতে আর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া অসংখ্য মানুষের লাশ পড়ে আছে চারদিকে। পুরো বস্তি পুড়ে ছাইয়ে পরিণত হয়েছে। সর্বত্রই ধ্বংস আর জীবন্ত মানুষের পোড়া গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা রাতে এসে প্রথমে যাদের বন্দি করেছিল, তাদের দিয়ে মৃতদেহগুলো টেনে আনিয়ে নীলক্ষেত পেট্রোল পাম্পের সামনে পড়ে থাকা দুটি ট্রাকের ওপর নিক্ষেপ করে। তারপর পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় ট্রাকে। পরে বন্দি করা মানুষগুলোকেও গুলি করে হত্যা করে ফেলে রাখে। এভাবেই সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যরা শত শত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট।
লেখক : সাংবাদিক