ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১

ঈদ উৎসবে পর্যটন সংস্কৃতি

খালিদ ইবনে আমিন

প্রকাশিত: ২০:০৩, ২৪ মার্চ ২০২৫

ঈদ উৎসবে পর্যটন সংস্কৃতি

এবারের ঈদ যাত্রা কিছুটা বিড়ম্বনাপূর্ণ হতে পারে। রাজধানী ঢাকা থেকে দূরপাল্লাগামী বিভিন্ন মহাসড়ক কোথাও দুই লেনকে চার লেন করা হচ্ছে। আবার কোথাও চার লেনকে আট লেনে ঊত্তীর্ণ করার কাজ চলমান। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল ও সিলেটগামী মহাসড়কের ১৫৯টি স্পটে যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। জাতীয় মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্পটগুলো ঈদের সাত দিন আগেই মেরামত কিংবা সংস্কার করার নির্দেশ দিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে রয়েছে ৫৪টি স্পট। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে রয়েছে ৪৯টি স্পট। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৪২টি স্পট এবং ঢাকা-পাটুরিয়া-আরিচা মহাসড়কে রয়েছে ৮টি স্পট। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে রয়েছে ৬টি স্পট। যমুনা সেতু হয়ে ঊত্তরাঞ্চলগামী গাড়িগুলোর প্রবেশমুখ বাইপাইল ও চন্দ্রা মোড়ে যানবাহনের প্রচণ্ড চাপ থাকে প্রতি বছর। যানজট নিরসনে জননিরাপত্তা বিভাগ ঈদের আগে ও পরে চিহ্নিত স্পটগুলোতে বিশেষ নজরদারি রাখতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়কে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। একদিকে যানজটের ভোগান্তি, অন্যদিকে রয়েছে নিরাপত্তাঝুঁকি, সব মিলিয়ে আশা ও শঙ্কা নিয়েই এবার ঈদ উদযাপন করবে দেশবাসী। অন্যান্য বারের চেয়ে এবার ঈদুল ফিতরে ৯দিনের লম্বা ছুটিতে যাচ্ছে দেশ। নাগরিক জীবনে মানুষ যখন হাসফাঁস করে, ঠিক তখন ৯ দিনের দীর্ঘ ছুটি নাগরিকদের পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দ-বিনোদনের জন্য অনুরাগী করবে। বাংলাদেশের সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামল প্রাকৃতিক পরিবেশ, পর্যটন শিল্পের বিকাশে আনুকূল্য তৈরি করেছে। নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, সাগর-উপকূল সবই রয়েছে আমাদের দেশে। কর্মময় নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা কাটিয়ে ঈদের লম্বা ছুটিতে অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম মানুষ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, জাফলংসহ দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাবেন। এছাড়া আত্মীয়-স্বজনের বাসাবাড়ি কিংবা পরিবারের সদস্যদের বিবাহ ও অন্যান্য  অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। সাধারণত দেশের পর্যটন এলাকাগুলোতে ঈদ যতই এগিয়ে আসে হোটেল-মোটেলে রুম পাওয়া ততই কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে, কক্সবাজারে হোটেলের সিটবুকিং করতে পারা অনেকটা সোনার হরিণ পাওয়ার মতো।
দেশের শীর্ষস্থানীয় পর্যটন স্পট কক্সবাজারের হোটেল ব্যবসায়ীরা জানান, এবার ঈদে ৯ দিনের দীর্ঘ ছুটির ফলে সমুদ্র সৈকতে ঢল নামবে পর্যটকের। আসন্ন ঈদুল ফিতরে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার নির্বাহী আদেশে ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। ঈদ উপলক্ষে পাঁচ দিন ছুটির সঙ্গে সপ্তাহিক ছুটি মিলে সরকারি চাকরিজীবীরা টানা ২৮ মার্চ থেকে (শুক্রবার) থেকে ৫ এপ্রিল (শনিবার) পর্যন্ত ৯ দিন ছুটি পাবেন। এর আগে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসের সরকারি ছুটি রয়েছে। ২৭ মার্চ (বৃহস্পতিবার) কর্মদিবসে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐচ্ছিক ছুটি নিলে ২৬ মার্চ থেকে ১১ দিনের ছুটি ভোগ করতে পারবেন। সাম্প্রতিককালে কর্মজীবী মানুষের জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ, পরিবার-পরিজনদের নিয়ে একান্ত সময় কাটানোর জন্য।
চার লক্ষাধিক পর্যটক সক্ষমতার হোটেল-মোটেলে ইতোমধ্যে ৩০ শতাংশ বুকিং সম্পন্ন হয়েছে। তাদের ধারণা, ঈদের আগেই সব বুকিং শেষ হয়ে যাবে। রমজানের অর্ধেক যেতে না যেতেই বুকিং শুরু হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদের লম্বা ছুটি কাটতে অনেকেই ১৫-২০ দিন আগে হোটেল বুক করেছেন কুয়াকাটা ও কক্সবাজারে। পর্যটন খাতের সূত্রমতে, প্রতি বছর ৫ লাখের মতো বিদেশী পর্যটক দেশে আসে। দেশীয় পর্যটক ২০ লাখের বেশি, যারা দেশের অভ্যন্তরে ভ্রমণ করে থাকেন। দেশের পর্যটন অর্থনীতি প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। দেশের জনপ্রিয় পর্যটনস্পটের তথ্য, সড়ক, রেল ও আকাশপথের যাত্রীদের চিত্র, ট্যুর অপারেটরদের তথ্যের ভিত্তিতে এবং দেশের পর্যটন খাত বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি বছর ঈদের ছুটিতে ২ হাজার কোটি টাকার পর্যটন বাণিজ্য হতে পারে। গত দুই বছরে ঈদুল ফিতর ঘিরে পর্যটন বাণিজ্যে দেড় হাজার কোটি টাকার টার্গেট ধরা হয়েছিল। এবার পর্যটন বাণিজ্য ২০-৩০ শতাংশ বাড়বে। সে হিসেবে এবার ২ হাজার কোটি টাকার বেশি টার্গেট ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন বলছে, ইতোমধ্যে তারা সব ধরনের প্রস্তুতি ও প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। দীর্ঘ ১১ দিনের ছুটির সম্ভাবনার সুযোগটা তারা কাজে লাগাতে চায়। স্পটগুলোতে পর্যাপ্ত পর্যটন পুলিশ নিয়োজিত থাকবে বিধায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
ঈদের আনন্দ মূলত ছোটদের। তাদের খুশি করতেই বড়দের যত আয়োজন। ঈদ মানেই তো নতুন পোশাক। অনেক পোশাক আছে, দেখতে চাকচিক্যপূর্ণ ও সুন্দর কিন্তু মেটেরিয়াল ভালো না হওয়ায় শিশুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নয়। শিশুর পোশাকে কেউ গুরুত্ব দেয় নকশা আর ফ্যাশন ট্রেন্ডে, কারও বিবেচনায় থাকে শিশুর স্বস্তিদায়ক পোশাক। চৈত্রের গরমে শিশুদের জন্য আরামদায়ক পোশাক প্রয়োজন। যে পোশাক পরলে শিশুরা অস্বস্তিবোধ করবে না। তবে অধিকাংশ বাবা-মা শিশুর পছন্দকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। গরমে আমাদের মা-বোনদের স্বস্তি পেতে হালকা রঙের শাড়ি যেমন- সুতির ব্লক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, অ্যাপ্লিকের শাড়ি, ছাপা শাড়ি, ব্লক-বুটিকের সুতি ট্রেন্ডি শাড়ি অথবা পাতলা সাটিন বা জর্জেটের শাড়িও উপযোগী। ঈদে ছেলেদের পোশাকের ক্ষেত্রেও সুতি কাপড়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বুটিক, ভেজিটেবল ডাই, টাইডাই, স্ক্রিনপ্রিন্ট, ব্লক ইত্যাদির ডিজাইন করা পোশাক পাওয়া যায়, যা অনেকের পছন্দ। এগুলো গরমে আরামদায়ক ও ফ্যাশনেবল। ঈদের নামাজ কিংবা দাওয়াতের জন্য এ সময় সুতির পাঞ্জাবিই ভালো। ঈদে ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে, ফুল হাতার বদলে হাফশার্ট পরা যেতে পারে। তরুণদের অনেকেই স্পোর্টস টি-শার্ট পরেন। এগুলোতে এমন ফ্যাব্রিক ব্যবহার করা হয়, যা খুব সহজে ঘাম ত্বকের উপরিভাগে নিয়ে যায়, ফলে শরীরে ঘাম বসে না। চৈত্রের ঈদে গরমে এ জাতীয় পোশাক বেশ আরামদায়ক।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, গত তিন মাসে (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি) ভারত ও পাকিস্তান থেকে ২২ লাখ ৩৫ হাজার পিস পোশাক আমদানি হয়েছে। গত রোজার আগে একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ২৬ লাখ পিস পোশাক। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিক্রি হচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার নামিদামি ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্রে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশীয় পোশাক খাতকে সুরক্ষা দিতে পোশাক আমদানিতে রয়েছে উচ্চ শুল্ককর। তারপরও অবৈধপথে আনা হচ্ছে পোশাক। ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশেও পোশাকের নতুন নতুন ব্র্যান্ড গড়ে উঠেছে, যা আশার আলো দেখাচ্ছে আমাদের।
ঈদের বাজারে পোশাক বেচাকেনা এখন তুঙ্গে। বাজারে দেশীয় পোশাকের প্রাধান্যই বেশি। গত এক দশকে দেশের বড় উদ্যোক্তারাও পোশাকের নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন। তবু ক্রেতাদের চাহিদার কারণে ঈদের আগে প্রতি বছর ভারত ও পাকিস্তান থেকে তৈরি পোশাকের আমদানি বাড়ে। ঈদের বাজারে যেভাবে দোকানে দোকানে ভারত-পাকিস্তানের পোশাক বেচাকেনা হয়, সে তুলনায় বৈধপথে আমদানি খুব কম। মূলত ভারত থেকে অবৈধপথে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক আমদানি হয়। অন্যদিকে পাকিস্তান থেকেও লাগেজে করে তৈরি পোশাক আসছে। চলতি বছর পাকিস্তান থেকে আমদানি হওয়া পোশাকের ৯৭ শতাংশই মেয়েদের পোশাক- থ্রিপিস, টুপিস ও ওয়ানপিস। গত তিন মাসে (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি) দেশটি থেকে থ্রিপিস আমদানি হয়েছে ৭ লাখ ৩৫ হাজার পিস। টুপিস ও ওয়ানপিস আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৪৭ হাজার পিস। পাকিস্তান থেকে ছেলেদের পাঞ্জাবি আমদানি হয়েছে ৪ হাজার ১৩৯ পিস। তৈরি পোশাকের বাইরেও পাকিস্তান থেকে কাপড় আমদানি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, বৈধপথের বাইরে পাকিস্তান থেকেও অবৈধভাবে পোশাক আসছে। অন্যদিকে ভারতীয় পোশাকের আমদানি কমেছে।
জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারত ভিসা দেওয়ার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে। ফলে এর অংশীজনরা মনে করে ছিল, এবারের ঈদে দেশীয় পোশাকের ব্যবসা হবে জমজমাট। দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারত ও পাকিস্তানি পোশাকে সয়লাভ বাজার। আমাদের মা-বোনদের কাছে পাকিস্তানি সালোয়ার-কামিজের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশ দুটি থেকে অবৈধভাবে তৈরি পোশাক আসায় দেশীয় পোশাকশিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে। দেশীয় শিল্প বাঁচাতে আামদের আরও দেশ প্রেমের পরিচয় দিতে হবে। সবার জন্য ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ, আনন্দময় এবং প্রতিটি জীবন থাকুক সুরক্ষিত আপন নীড়ে।
লেখক : সাংবাদিক

×