
পবিত্র কুরআন মুসলমানদের জন্য এক শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। রমজান মাসে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ায় এর মর্যাদা আরও বেশি। রমজান মাসে লাওহে মাহফুজ থেকে পূর্ণ কুরআন একসঙ্গে দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হয়। অতঃপর রাসুলের (সা.) ২৩ বছর নবুয়তের জিন্দেগিতে অল্প অল্প করে কখনো এক আয়াত, কখনো একটি সুরা- এভাবে পূর্ণ কুরআন রাসুলের কাছে অবতীর্ণ হয়। পবিত্র কুরআন দু’ভাবে নাযিল হয়েছে- ১. ষোল আনা কুরআন এক সঙ্গে নাযিল হওয়া। ২. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুওয়াতী জিন্দেগিতে প্রয়োজন ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কখনো একটি সূরা, কখনো কয়েকটি আয়াত পর্যায়ক্রমে নাযিল হওয়া। প্রথম ধাপ অর্থাৎ ষোলো আনা কুরআন ১৫ শাবানের রাতে (অর্থাৎ ১৪ শাবান দিবাগত রাতে) লাওহে মাহফুজে নাযিল হয়েছে। এ রাতকে আল কুরআনে ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাতুন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছেÑ ‘নিশ্চয় আমি এটা (আল কুরআন) এক মুবারক রাতে নাযিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি ‘সতর্ককারী’। (সুরা আদ্দুখান : ৩)। এ রাতকে মুবারক বলার কারণ এই যে, এ রাত্রিতে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে অসংখ্য কল্যাণ ও বরকত নাযিল হয়। মনে রাখা দরকার যে, ফারসি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় লাইলাতুম্ মুবারাকাতুন’-কে ‘লাইলাতুল বারাত’ বলা হয়। দ্বিতীয় ধাপ, অর্থাৎ ষোলো আনা কুরআন লাওহে মাহফুজ হতে রমজান মাসের ২৪ তারিখ দিবাগত রাতে প্রথম আকাশের ‘বাইতুল ইজ্জতে’ নাযিল হয়েছে। আল কুরআনে এই রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় ‘লাইলাতুল কদর’ অর্থ মর্যাদাপূর্ণ রাত, মহিমান্বিত রাত। আবার এই রাতকে ভাগ্য রজনীও বলা হয়। অর্থাৎ, কোনোরকম কাগজ, কালি কিংবা প্রিন্টিং ছাড়া প্রায় ১৫শ’ বছর পূর্বে হযরত মুহাম্মদের (সা.) কাছে এভাবেই এসেছিল এবং আজ পর্যন্ত অত্যন্ত সযত্নে সংরক্ষিত হয়ে আছে। কুরআনের ভাষাগত ও সাহিত্যিক মান অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের। এর ভাষা যেমন স্বচ্ছ, তেমনি এর বাক্য বিন্যাসও অত্যন্ত নিখুঁত ও অভিনব। নবী করীম (সা.) যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন, তখন এর ঝংকার ও সুরমাধুরী তাঁর সমভাষীদের মন মগজকে মোহিত করে তুলত। তারা বাস্তবভাবে উপলব্ধি করতেন যে, এ কালাম কিছুতেই মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়। তা সে আরবি সাহিত্যের যত বড় পণ্ডিতই হোক না কেন। যদিও পূর্ব পুরুষের অন্ধ অনুকরণ, গোত্রীয় অহমিকা ও সংকীর্ণ স্বার্থবোধ কুরআনকে হক বলে গ্রহণ করার পথে তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রেখেছিল। কিন্তু তারা এ কথা ভালোভাবে উপলব্ধি করত যে, একজন উম্মী লোকের পক্ষে, যে কোনোদিন পাঠশালার বারান্দাও যায়নি, এ ধরনের উচ্চমানের কালাম রচনা করে পেশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। স্বয়ং কুরআনই একাধিকবার আরবদের খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ করেছে যে, ‘তোমরা যদি একে নবীর (সা.) রচিত বাণী বলে মনে কর, তাহলে তোমরা এ ধরনের বাণী তৈরি করে দেখাও।’ তাই সমগ্র মুসলিম জাহান মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে কুরআনের এই বাণী (আল্লাহর বাণী) কেয়ামত পর্যন্ত অটুট থাকবে এবং এর একটি অক্ষরও কেয়ামত পর্যন্ত পরিবর্তন হবে না। কোনো রকম প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া শতাব্দীর পর শতাব্দী এভাবে কুরআন সংরক্ষণ রাখা মহান আল্লাহতালার এক অলৌকিক নিদর্শন। অথচ বর্তমান বিশ্বে সমস্ত প্রিন্টিং জগৎ প্রযুক্তির এক বিস্ময়কর কল্যাণে নিমজ্জিত। প্রিন্টিং জগতের সব কিছুই ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে এসেছে আধুনিকতা। সংরক্ষিত হচ্ছে অফলাইন ও অনলাইনে। এ অবস্থা থেকে বাদ যায়নি পবিত্র কুরআন শরীফও। হক্কানী আলেমদের সুরেলা কণ্ঠে এবং বিভিন্ন ভাষায় পবিত্র কুরআনের লিখন, পঠন, তেলাওয়াত, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সমস্ত পৃথিবীর মুসলমানদের এক অনন্য আকর্ষণ।
আরবি ভাষায় রচিত হওয়ায় কুরআন শরীফ পড়া, শিখা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করা ভিন্ন ভাষাভাষী লোকদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু ডিজিটাল কুরআন শরীফ এই সমস্যা থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। শুদ্ধ উচ্চারণ এবং মিষ্টি সুরসহ ডিজিটাল কুরআন শরীফের অফলাইন ও অনলাইন সংস্করণ এখন প্রচুর। ফলে যে কোনো বয়সের লোকজন যে কোনো সময় কুরআন শরীফ পড়তে এবং শিখতে পারেন অনায়াসে। এমনকি আরবি অক্ষরের শুদ্ধ উচ্চারণ, ব্যাকরণ ও ব্যবহারবিধি চমৎকারভাবে বর্ণনা করা থাকে বিভিন্ন অনলাইন টিউটোরিয়ালে, যা ইউটিউব চ্যানেলে সবার জন্য উন্মুক্ত। কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনের মাধ্যমে শিখার জন্য আছে নানা কৌশল যেমন- আরবি বর্ণমালার সঠিক উচ্চারণ। কুরআন মাজিদ তেলাওয়াতের জন্য প্রয়োজনীয় আরবি ব্যাকরণের সমস্ত নিয়ম যেমনÑ তাশদীদ, তানভিন, জাযাম ইত্যাদি। তিলাওয়াত শ্রুতিমধুর করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল কৌশল, ধারাবাহিকভাবে কুরআন শেখার জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিষয়। কিভাবে সহজে সুরাসমূহ মুখস্থ করতে হয় কিংবা কুরআন মাজিদ শেখার বিষয়গুলো আয়ত্ত করতে হয় তা সম্পর্কে সঠিক গাইডলাইন।
বর্তমান সময়ে সকলের কাছেই স্মার্টফোন রয়েছে। একই সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগও প্রায় সকলের মোবাইলে রয়েছে। সুতরাং চাইলে ঘরে বসে ইউটিউব থেকে বিভিন্ন কুরআন শিক্ষা লেসন দেখার মাধ্যমেও কুরআন শিক্ষা সহজে অর্জন করা যায়। ইউটিউবে অসংখ্য প্লে-লিস্ট এবং ভিডিও রয়েছে কুরআন শেখার বিষয়ে। নিঃসন্দেহে ইউটিউব এর মাধ্যমে কুরআন শিক্ষা বর্তমান সময়ের জন্য একটি অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য আছে ডিজিটাল ব্রেইল কুরআন। এ পদ্ধতির কুরআনগুলো ইলেকট্রনিক। সরবরাহ করছে কাতার দাতব্য ফাউন্ডেশন। ব্রেইল পদ্ধতির এ সব ডিজিটাল কুরআন ‘মুসহাফে বাসিরাত’ নামে প্রসিদ্ধ। এ কুরআন শরিফের সঙ্গে থাকে অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম ও একটি ইলেক্ট্রনিক কলম। বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত এই ইলেকট্রনিক কলম দিয়ে নির্দিষ্ট ব্রেইল কোড চাপলে- সূরার তালিকা, সুরার অর্থ ও তেলাওয়াত শোনা যায়। কলমের গায়ে লিখিত/বর্ণিত ভাষা সিলেক্ট করে চাপলে নির্বাচিত ভাষায় কুরআন তেলাওয়াত শোনা যায়, শেখা যায়। এভাবে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা কুরআন শুনে শুনে সহজে তেলাওয়াত শিখতে পারছেন। কাতার দাতব্য ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়াসহ সমগ্র বিশ্বে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মাঝে এই ডিজিটাল ব্রেইল কুরআন বিতরণ করে আসছে।
বর্তমানে অত্যন্ত মসৃণ ও নিখুঁতভাবে যে কুরআন শরীফটি পাওয়া যায়, তা আসে সৌদি আরবের মদিনা থেকে। এই শহরের কিং ফাহাদ কমপ্লেক্স থেকে পৃথিবীর ৭০টি ভাষায় কোটি কোটি কপি কুরআন শরীফ ছাপা হয়েছে এবং হচ্ছে। এই অত্যাধুনিক কমপ্লেক্স তথা ডিজিটাল প্রিন্টিং প্রেসে বছরে ১২ মিলিয়নের অধিক সংখ্যক পবিত্র কুরআন শরীফ ছাপা হয়। অতি বিজ্ঞ কুরআনের হাফেজ, আলেম, বুজুর্গসহ বিভিন্ন পদে এখানে প্রায় ১৭০০ লোক কাজ করে। প্রায় ৮-১০টি ধাপে এক খণ্ড কুরআন ছাপা হয়, যার প্রতিটি নিখুঁত স্তরের সঙ্গে নিখুঁত ছোঁয়া, শুদ্ধ উচ্চারণ ও স্পষ্ট মুদ্রণ। বাংলাদেশের বাজারে আরবির পাশাপাশি বাংলায় মুদ্রিত অর্থসহ হরেক রকম কুরআন শরীফ পাওয়া যায়, দামও সাধ্যের মধ্যে। এছাড়া ডিজিটাল কুরআন শরীফ বাংলাদেশ অথবা বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা যায় যা আন্তর্জাতিক ২১ জন কারীর কণ্ঠে পঠিত। শব্দে শব্দে, আয়াত বাই আয়াত বা পুরো সুরা একসঙ্গে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজিতে শোনা যায়। নিজে নিজে কুরআন শিক্ষার এক ডিজিটাল আবিষ্কার এই ডিজিটাল কুরআন শরীফ। সঙ্গে থাকে ৫টি অতিরিক্ত বই, ১টি কুরআন রিডিং পেন, ১টি চার্জার, ১টি গাইডলাইন বই, ১টি চার্জর, ১টি ইয়ারফোন, ১টি স্পেশাল গোল্ডেন কালার বক্স। পাঠকের সুবিধার্থে অফলাইন এবং অনলাইন দুই ভাবেই সংগ্রহ করা যাচ্ছে।
লেখক : অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়