
শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই বিশ্বের বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় সুন্দরবনের একাংশে আগুন লেগেছে। এবারে আগুন লেগেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের কলমতেজী ফরেস্ট টহল এলাকায়। তবে ঘটনাস্থলটি বন বিভাগের কার্যালয় থেকে বেশ দূরে। স্থানীয় জেলেদের কাছে স্থানটি টেপারবিল নামে পরিচিত। পাশেই বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের পশ্চিম রাজাপুর গ্রাম। সেখানে অন্তত এক-দেড় কিলোমিটার এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে আগুন ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। পরে বন বিভাগ, স্থানীয় বাসিন্দা ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা একযোগে কাজ শুরু করেন আগুন নিয়ন্ত্রণে। ফায়ার সার্ভিসের ৫টি স্টেশনের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলেও এলাকায় পানির উৎস না থাকায় এবং রাত হয়ে যাওয়ায় কাজ করতে পারেননি আগুন নিয়ন্ত্রণে। পরে কিছুটা দুর্গম ও দূরবর্তী রাজাপুর গ্রামসংলগ্ন ভোলা নদী থেকে পানি নিয়ে কাজ শুরু করেন। আগুন নিয়ন্ত্রণে দেড় কিলোমিটারব্যাপী ফায়ার লাইন কাটা হয়েছে, যাতে আগুন আর ছড়িয়ে না পড়ে। তবে এর রেশ কাটতে না কাটতেই অন্যত্র আগুন লাগার খবর পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, এর আগে গত বছরের মে মাসের শুরুতে সুন্দরবনের একই রেঞ্জে আমোলবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফেরছিলা এলাকায় আগুন লেগে ৫ একর বনভূমির গাছ-পালা পুড়ে যায়। তারও আগে ২০২১ সালের ৩ মে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসেরভারানি এলাকায় আগুন লেগেছিল। এই বনে গত ২৩ বছরে শুষ্ক মৌসুমে অন্তত ২৬ বার আগুন লেগেছে, যা রহস্যজনক। যেগুলোর অধিকাংশই লোকালয় সংলগ্ন ভোলা নদী তীরের উঁচু বনাঞ্চল। বনে সাধারণত আগুন লেগে থাকে বজ্রপাত অথবা প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে গাছে গাছে সংঘর্ষের কারণে। বন থেকে মধু, গোলপাতা, সুন্দরী গাছ আহরণরত ব্যক্তিদের ফেলে আসা বিড়ি-সিগারেটের টুকরা থেকেও আগুন লাগা বিচিত্র নয়। তবে তা খুব কমই ঘটে থাকে। প্রতিবছরই বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্গত সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী কোনো সংঘবদ্ধ চক্রের হাত রয়েছে। ফলে, প্রতিবছরই পুড়ছে বনের নতুন নতুন এলাকা। বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, সর্বশেষ অগ্নিকান্ডসহ আগের ২৭টি ঘটনায় সুন্দরবনের প্রায় ৯০ একর বনভূমির বিভিন্ন ধরনের গাছপালা পুড়ে যায়। ধ্বংস হয়েছে জীববৈচিত্র্য। স্থানীয় গ্রামবাসীদের ভাষ্য, প্রধানত মাছ চাষের জন্যই প্রতিবছর এক বা একাধিক দুষ্টচক্র আগুন লাগিয়ে থাকে সুন্দরবনে। এ নিয়ে থানায় মামলা দায়েরসহ গ্রেপ্তারের খবরও আছে। তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছেই।
সুন্দরবন একদিকে যেমন বাংলাদেশের গর্ব, অন্যদিকে বিশ্ব ঐতিহ্য বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশও বটে। আর তাই বন ও জলদস্যুদের উৎপাত এবং দুর্বৃত্তদের বারবার আগুন লাগানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক বৈকি। চক্রটি শুকনো মৌসুমে বনে আগুন লাগিয়ে প্রশস্ত করে মাছ চাষের পথ। এর পাশাপাশি বনের জায়গা দখল করাও আরেকটি উদ্দেশ্য। বেড়েছে বনদস্যুদের উৎপাতও। বন না থাকলে একদিকে যেমন বাঘ, চিতল হরিণ-পাখ-পাখালি সহ অমূল্য বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হবে; অন্যদিকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসসহ বিবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন হবে জনপদ ও বসতি। সুন্দরবনের সুরক্ষায় সরকার গৃহীত বিবিধ পদক্ষেপের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ড্রোনসহ স্মার্ট প্যাট্রোলিং সিস্টেম, যা মূলত স্পেশাল মনিটরিং এ্যানালাইজিং অ্যান্ড রিপোর্টিং টুল। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে স্মার্ট প্রযুক্তির আওতায় ব্যবহৃত হচ্ছে প্যাথেরা নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তুতকৃত অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থা। বন ও বন্যপ্রাণী সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও অপরাধ সম্পর্কিত তথ্যাদিও সংগ্রহ করা হয় এর মাধ্যমে। বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার পাশাপাশি বনসংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ধরতেও সহায়ক হতে পারে এই ব্যবস্থা।