
মানচিত্র ভূমির সাংকেতিক প্রতিচ্ছবি। মানচিত্রের মাধ্যমে কোনো অঞ্চল বা দেশের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, উদ্ভিদ, মাটি, পানি ও অনেক কিছু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এর সাহায্যে আমরা বিভিন্ন মহাদেশ ও মহাসাগরের অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে পারি। প্রযুক্তির উন্নয়নে দিন দিন মানুষের জীবনযাত্রায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সব থেকে কঠিন কাজও এখন হয়ে যাচ্ছে খুব সহজ। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তিতে গুগল ম্যাপ তেমনি এক চমক। গুগল ম্যাপ হলো একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং কার্যকরী অ্যাপ যা ব্যবহারকারীদের ভৌগোলিক অবস্থান ও দিকনির্দেশনা সঠিকভাবে প্রদানে সহায়তা করে থাকে। গুগল ম্যাপ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করেছে। এখন প্রাত্যহিক জীবনে আমরা সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছাতে কিংবা দিকনির্দেশনা ও দূরত্ব জানতে গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে থাকি। অ্যাপটির সাহায্যে অচেনা পথ পেরিয়ে ও নির্দিষ্ট গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব। কেউ পথ হারালে সহজে রাস্তা খুঁজে পেতে গুগল ম্যাপ ব্যবহার করেন। আমাদের দেশে গুগল ম্যাপ যতটা কাজের উন্নত দেশে এটি তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি কাজের।
বিশ্বের মানচিত্র হচ্ছে পৃথিবীর পৃষ্ঠের বেশিরভাগ বা সমস্ত অংশের একটি মানচিত্র। প্রাগৈতিহাসিক সময়কাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত সঠিক বিশ্বের মানচিত্র তৈরি করা অসম্ভব ছিল। কারণ যেকোনো সংস্কৃতির কাছে পৃথিবীর অর্ধেকেরও কম উপকূলরেখা এবং এর মহাদেশীয় অভ্যন্তরীণ অংশের একটি ছোট অংশ পরিচিত ছিল। ইউরোপীয় রেনেসাঁ সময় শুরু হওয়ার সময়ে গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর পৃষ্ঠের জ্ঞান দ্রুত সঞ্চিত হয়। যার ফলে পৃথিবীর বেশিরভাগ উপকূলরেখার মানচিত্র ১৭৫০Ñ এর দশকের মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল। আর বিংশ শতাব্দীর মধ্যে মহাদেশীয় অভ্যন্তরীণ মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। ১১৫৪ সালে সর্বপ্রথম বিশ্বের মানচিত্র তৈরি করেছিলেন মুহম্মাদ আল-ইদ্রিসি। তার জন্মস্থান ছিল সেউতাতে যা তৎকালীন আলমোরাভিডদের অন্তর্গত ছিল। তিনি তাবুলারোজেরিয়ানা তৈরি করেছিলেন যা ছিল মধ্যযুগীয় বিশ্বের অন্যতম উন্নত মানচিত্র। মানচিত্র অঙ্কন বিদ্যাকে বলা হয় কার্টোগ্রাফি। মূলত এই শব্দটি মানচিত্র অধ্যয়ন বা মানচিত্র তৈরির অনুশীলনকে বোঝায়। বর্তমান আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে নেভিগেশন বা রাস্তা চিনতে গুগল ম্যাপের জুড়ি নেই। প্রযুক্তিনির্ভর এই যুগে গুগল ম্যাপ কেবল একটি নেভিগেশন টুল নয় বরং এটি আমাদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
গুগল ম্যাপের প্রধান সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে রিয়েল-টাইম নেভিগেশন, যা যাত্রীদের ট্রাফিক পরিস্থিতি এবং পথের অবস্থা অনুযায়ী দ্রুততম রুট নির্ধারণে সাহায্য করে। প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ প্রতিদিন তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য, কাছাকাছি স্থান খুঁজে বের করার জন্য এবং ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে এই অ্যাপটি ব্যবহার করেন। এই গুগল ম্যাপস (এড়ড়মষব গধঢ়ং) মূলত গুগল (এড়ড়মষব) কর্তৃক পরিচালিত একটি বিনামূল্যের ম্যাপিং সার্ভিস। এটি বিভিন্ন ধরনের ম্যাপ এবং লোকেশনভিত্তিক সেবা সরবরাহ করে থাকে। যেমনÑ পথনির্দেশনা, লোকেশন খোঁজা, রাস্তা বা এলাকা পরিদর্শন ইত্যাদি। এড়ড়মষব গধঢ়ং আপনাকে বিশ্বব্যাপী যেকোনো জায়গার স্যাটেলাইট ভিউ, স্ট্রিট ভিউ এবং ট্রাফিক কন্ডিশন দেখার সুযোগ দেয় ইত্যাদি। গুগলম্যাপস এখন স্যাটেলাইট চিত্র, এরিয়াল ফটোগ্রাফি, রাস্তার মানচিত্র, রাস্তার ৩৬০ ডিগ্রি ইন্টারেক্টিভ প্যানোরামিক ভিউ (রাস্তার দৃশ্য), রিয়েল-টাইম ট্রাফিক পরিস্থিতি এবং পায়ে, গাড়িতে, বাইকে, বিমানে (বিটাতে) এবং পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ভ্রমণের জন্য রুট পরিকল্পনাও প্রদান করে থাকে। গুগল ম্যাপস একটি সি++ ভিত্তিক ডেস্কটপ প্রোগ্রাম হিসেবে শুরু হয়েছিল যেখানে লারস এবং জেনস রাসমুসেন দুই ভাই মূলত এই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। লারস ও জেনস রাসমুসেন নামের দুই ভাই ‘হোয়্যার টু টেকনোলজিস’ নামে প্রতিষ্ঠানে সি++ প্রোগ্রামিং ভাষায় ডেস্কটপ কম্পিউটারের জন্য মানচিত্রের এই প্রোগ্রাম তৈরি করেছিলেন। ২০০৪ সালের অক্টোবর গুগল এই প্রতিষ্ঠানকে অধিগ্রহণ করে। এরপর মানচিত্রের এই প্রোগ্রামকে ওয়েবভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশনে রূপান্তর করা হয়। বর্তমানে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় যেতে হলে গুগল ম্যাপসের দেখানো পথ অনুসরণ করেন বেশির ভাগ মানুষ। ২০০৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ওয়েবভিত্তিক এই মানচিত্র ও পথনির্দেশক অ্যাপ্লিকেশন চালু করে গুগল। এছাড়াও পরীক্ষামূলকভাবে আকাশপথের নির্দেশনায় দেখাচ্ছে গুগলম্যাপস।
প্রতিমাসে সারা পৃথিবীতে ১০০ কোটির বেশি মানুষ গুগল ম্যাপস ব্যবহার করে থাকেন। ২০০৬ সালে গুগল ম্যাপসের মোবাইল সংস্করণ প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে ৭৪টি ভাষায় গুগলম্যাপস পাওয়া যায়। প্রায় ২০ বছর পূর্বে যখন পৃথিবী কাগজের মানচিত্র থেকে ডিজিটাল মানচিত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল তখন থেকে গুগল ম্যাপ ভ্রমণ সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা চিরতরে বদলে দিয়েছিল। কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা প্রথমবারের মতো গুগলম্যাপের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন ২০০৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। ডিজিটাল এই মানচিত্রের লক্ষ্য ছিল মানুষকে ‘বিন্দু থেকে বিন্দুতে যেতে’ সাহায্য করা। আজ বিশ্বজুড়ে বিলিয়নেরও বেশি মানুষ প্রতি মাসে রাস্তাঘাট চেনা এবং ভ্রমণের ক্ষেত্রে গুগলম্যাপের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। বর্তমানে গুগল ম্যাপ এখন একটি মানচিত্রের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এই গুগল ম্যাপ বিশ্ববাসীর জন্য একটি জীবন্ত মানচিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে যা ক্রমাগত তথ্য ভাগ করে এবং আপডেট করে চলছে। প্রতিদিন প্রায় ১০০ মিলিয়নেরও বেশি আপডেট যোগ করা হয় এই গুগল ম্যাপে। তাই এটি বিশ্বব্যাপী একটি আপ টু ডেট মানচিত্র হিসেবে কাজ করে। ফলে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ এখন যেখানে যেতে চান সেখানে যাওয়ার জন্য এই গুগল ম্যাপের ওপর নির্ভর করে থাকেন।
এ ছাড়া এই গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে বিশ্বের প্রায় ২৫ কোটি ব্যবসা এবং স্থান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এই গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে আমরা যেকোনো জায়গায় যাওয়ার আগে জানতে পারি সেখানে কতটা ভিড় অর্থাৎ ট্রাফিক যানজট রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় আমরা কোনো স্থানে গেলে সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল অথবা না থাকার কারণে আমাদের নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর সে সময় কোনো স্থান ম্যাপে খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এরকম সমস্যা থেকে নিস্তার পেতেই গুগলম্যাপে রয়েছে অফলাইন ম্যাপ সেইভ করে রাখার সুবিধা। যার সাহায্যে মোবাইল ডেটা কিংবা ইন্টারনেটের সুবিধা না থাকলেও ম্যাপ চালানো যাবে। অপরদিকে প্রতিনিয়তই আমরা বিভিন্ন ধরনের কাজের উদ্দেশ্যে নানান জায়গায় যাই। গুগলম্যাপের টাইম লাইন ফিচারের সাহায্যে প্রতিদিন বা প্রতিমাসে আমরা কোন্ কোন্ স্থানে গিয়েছি সে সকল স্থানের তালিকা খুব সহজেই পাওয়া যাবে। আমাদের প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ কোথাও যেতে দেরি হওয়া, রাস্তা হারানো কিংবা কাছাকাছি জরুরি সেবা খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি। আর এই সবকিছুই গুগল ম্যাপস সহজ করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, পর্যটন, ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত জীবনেও এই গুগল ম্যাপের সেবা দারুণভাবে কার্যকর।
লেখক : নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটিসেল)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা