ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৫ মার্চ ২০২৫, ১১ চৈত্র ১৪৩১

ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ, নির্বিঘ্ন

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ২৩ মার্চ ২০২৫

ঈদযাত্রা হোক নিরাপদ, নির্বিঘ্ন

আমরা এখন পবিত্র রমজানের শেষ সময় পার করছি। সামনে অপেক্ষমাণ ধর্মীয় ঈদুল ফিতর। বাংলাদেশ এখনো শস্য শ্যামল গ্রামীণ অভাবনীয় নির্মাল্যে যেন সবুজের সমারোহে বেষ্টিত। সিংহভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। শৈশব থেকে কৈশোরের মূল নাড়ির বন্ধন কিন্তু আজ অবধি পল্লীবালার নির্মল আবেশে সিক্ত। উন্নয়নের পালাক্রমে শহর-গ্রামের ফারাক অনেকটা ঘুচে গেলেও জনসংখ্যা পরিবেষ্টিত গ্রাম বাংলা এখনো তার শৌর্য বীর্যে অভাবনীয় সৌন্দর্যস্নাত অঞ্চলের পরম বরমাল্য। শহর নগরায়নের আধুনিক পালাক্রমে একটু ভিন্নমাত্রার জীবন যাপনে পল্লী জননীর কোল ছেড়ে আসা মানুষের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। শহর বন্দর নগরের ক্রম প্রসারণ আধুনিক বাংলাদেশের জন্য এক অপরিহার্য যাত্রাপথ তো বটে। শিল্প বিকাশের মহাসন্ধিক্ষণে সাধারণ মানুষ শহরে বন্দরে বসতি স্থাপনের যে পালাক্রম তা কোনোভাবেই সরল রেখায় চলেনি। তারপরও নগর শহরের ক্রমবিস্তারও সমাজ সভ্যতার অনুষঙ্গ বলাই যায়। কোনো এক সময়ের পল্লীবালার সুযোগ্য সন্তানরা শহরে এসে কর্মজগৎ তৈরি করাও যুগ সময়ের আবেদন। পল্লী জননীর শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে ঘরবাড়ি, উঠান সাজানো গোছানো মায়েরাই দেশের আধুনিক প্রজন্ম উপহার দিয়েছেন। যারা আজ সফলতার শীর্ষে অবস্থান করে দেশের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে যাচ্ছেন। সংগত কারণে শহরের সঙ্গে গ্রামনির্ভর মানুষের নাড়ির টান যে অবিচ্ছেদ্য তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। মনে রাখা আবশ্যক সে সময়ের গৃহিণী মায়েরা সন্তানকে যোগ্যতমভাবে তৈরি করে শহরের দিকে এগিয়ে দিয়েছেন সন্দেহ নেই। যারা আজ শ্রেষ্ঠতম বিবেচনায় শুধু শিক্ষা কার্যক্রমই নয়, বরং পেশাগত অবস্থানেও নিজেদের প্রমাণ করে যাচ্ছেন। কিন্তু স্নেহছায়ায় লালন-পালন করেও গ্রামবাসী মায়েরা সন্তানদের ছেড়ে দিয়েছেন শহরের অভিমুখে। কিন্তু তারা আসেননি শেকড় ছেড়ে শহর ও নাগরিক সভ্যতায় নিজেদের যুক্ত করতে। সংগত কারণে গ্রাম-শহরের বন্ধন আজও অবিচ্ছিন্ন অটুট। কাজের জায়গা শহরের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায়। কিন্তু মায়ের টানে কিংবা শেকড়ের আহ্বানে দুই ঈদ আনন্দে গ্রামে যাওয়া যেন আর এক উৎসব আয়োজন তো বটে। ঢাকা শহরের অনেক মানুষ সেই নাড়ির টানে গ্রামে চলে যায় শত ব্যস্ততা আর ঝুট ঝামেলার মধ্যেও। যা সব সময় চিহ্নিত শেকড় কিংবা নাড়ি টানে পল্লী জননীর পানে ছুটে চলা। যেখানে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় আমাদের দুটো মহান ঈদ উৎসব পর্বে। সরকারও বিভিন্নভাবে ছুটি বরাদ্দ করে যাতে গ্রামে গিয়ে শহুরে মানুষরা ঈদ আনন্দ উৎসব উদযাপন করতে কোনো বেগ না পায়। এবার কিন্তু ঈদের সরকারি ছুটি লম্বা ৯ দিন। অনেকে আবার আগ পিছ করে কিছু ছুটি নিয়ে সেটা আরও দীর্ঘ করতে দেখা যায় প্রতিবছর দুই ঈদেই। এবার টিকিট বিক্রয় ছিল অনলাইনে। যার কারণে টিকিট কিনতে সেভাবে ভোগান্তি পোহাতে হয়নি দূরপাল্লার যাত্রীদের। তবে হিসেবে আনা হচ্ছে রাস্তায় যাত্রী দুর্ভোগের বিষয়। যানজট তো লেগেই থাকে। সোয়া কোটির মতো মানুষ ঢাকা ছেড়ে নিকটজনদের কাছে গ্রামের অভিমুখে যাবেন। যেখানে অপেক্ষা করছেন আত্মীয়স্বজন পরম বন্ধুবান্ধবেরাও। বিভিন্ন সড়কের সংযোগস্থল তো আছেই জেলা থেকে অন্য জেলায়। শেষ অবধি গন্তব্যেও। সময় মতো টিকিট বিক্রি হলেও নির্ধারিত যাত্রা কতখানি আশঙ্কামুক্ত হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীরা। কঠিন যানজট দেশের এক দৃষ্টিকটু বিষদৃশ্য। যা কোনোভাবেই ঠেকানো যায়নিÑ যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ। সড়ক মহাসড়কের যে অত্যধিক যান চলাচল তা শুধু যাত্রা ভোগান্তিই নয় বরং অনেকাংশ জুড়ে থাকে নিরাপত্তার ঝুঁকিও। তবে সড়ক যোগাযোগের মূল স্থানে বাড়তি নজরদারি বরাবরই প্রয়োজন হয়। কিন্তু দুর্বিপাক বা দুর্ঘটনা সেভাবে এড়ানো যায়ও না। আগের বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় যা দৃশ্যমান হয়েছে। এ বছরও তার খুব ব্যতিক্রম হবে বলা মুশকিল। জবাব সময়ের হাতে। কাক্সিক্ষত-অনাকাক্সিক্ষত সবই যেন বিনিসূতোয়  গাঁথা এক ঝড়ো হাওয়া। কখন কোথায় কি পরিস্থিতি তৈরি হবে চালক থেকে যাত্রী কেউ অনুধাবনও করতে হিমশিম খায়। তবে চিহ্নিত বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে ও স্পটে বাড়তি নজরদারি করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেছেন। প্রতিবারেই তাই করেন। তবে যা ঘটার তা ঘটতে নিমিষও  লাগে না। সেখানে দক্ষিণবঙ্গের যাত্রাপথে পদ্মা সেতুর যে নয়নাভিরাম যান্ত্রিক অবকাঠামো তার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন পথ পাড়ি দেওয়ার যে স্বস্তিকর পরিবেশ তা এখন যাত্রীদের  জন্য পরম বরমাল্য তো বটেই। এ তো গেল সড়ক মহাসড়কের যাত্রা ভোগান্তি কিংবা কমে যাওয়ার ব্যাপার। তার ওপর আছে আরও কত বিপদ-বিপত্তি।
নদীস্নাত ও সমুদ্র পরিবেষ্টিত আবহমান বঙ্গভূমি। তাই ঈদযাত্রার একটা অংশ থাকে জলের মধ্যে নদী সাগর পাড়ি দেওয়া। সেখানে ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি, বড় লঞ্চ তো থাকেই। আবার জাহাজে ও সাগর পাড়ি দিয়ে যাত্রাপথের ক্লান্তি সেভাবে কাটানোও যায় না। তবে পদ্মা সেতুর নবনির্মাণে নদী সাগর পাড়ি দেওয়ার অনেক ঝক্কি ঝামেলা কমেও গেছে যা বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে উঠে আসছে। তবে নদী সাগরের ভ্রমণ তৃপ্তি আর আনন্দদায়ক। আনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার চাপ থাকেই না। তবে জোয়ারের অনুকূল প্রতিকূলে কিছু ফারাক তো দৃশ্যমান হয়ই। যা পানিপথের যাত্রাতে সহনীয়ই বলা যায়। দুর্ভোগ, দুশ্চিন্তার জায়গাই থাকে না। তবে ভ্রমণটা অতি অবশ্যই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু আরামদায়ক এবং দুশ্চিন্তামুক্ত। নদী সাগরের হাওয়ায় শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় নদী-বিধৌত আর সমুদ্রবেষ্টিত পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আর সুনির্মল বাতাসে।
আবার উন্নয়নশীল বাংলাদেশে আকাশ পথে ভ্রমণ করা আরও এক আধুনিকতার বরমাল্য। তবে দেশের সব জায়গায় বিমানবন্দর নেই। যশোরে থাকলেও বন্দরনগরী খুলনায় নেই। যশোরের সঙ্গে খুলনার যোগাযোগ অতি অবশ্যই সড়কপথে। যেখানে অভিজাত যাত্রীরা সামান্য বিপাকে তো পড়েনই। নিরবচ্ছিন্ন ভ্রমণই আলাদা মাত্রার। এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে যাওয়া আসলেই ক্লান্তিকর, ঝুঁকিপূর্ণ এবং পথের অনাবশ্যক দুর্ভোগ তো থাকেই। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছেন অন্য জায়গায়। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি নিয়ে। ইদানীং তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়াও আর এক যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি। তবে ঈদযাত্রায় ভোগান্তি থাকেই। সেটা রাস্তায় হোক বা নদী-সাগরে হোক না কেন। দীর্ঘ যাত্রা সুখকর কিংবা স্বস্তিদায়ক হওয়া আসলেই কঠিন। সবকিছু নির্ভর করে উপস্থিত সময় আর পরিস্থিতির ওপর। যার নিয়ন্ত্রণ সবার হাতে থাকেও না। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকার বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশকে যেভাবে সাজাতে গোছাতে চেষ্টা করছেন সেখানে কিছু সংস্কারও রদবদল জরুরি হয়ে পড়েছে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীও ঢেলে সাজানোর নতুন প্রক্রিয়ায়। তেমন কার্যক্রমে ভিন্নমাত্রার নির্দেশনায় পথের ক্লান্তি, অঘটন, কিছু অনিয়ম ঘুচে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকছে। এবার দীর্ঘ ঈদযাত্রাকে সহনীয় করতে বর্তমান সরকার সেনাবাহিনী, বিজেবি ও র‌্যাবকে সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব প্রদান করেছে। বিশেষ করে যেসব স্থানে মাত্রাতিরিক্ত যানজট হয় সেখানে মহাসড়কে পুলিশের সঙ্গে ভলান্টিয়ার থাকার নির্দেশও এসেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বিপদশঙ্কুল দীর্ঘযাত্রায় সব সময় ভোগান্তি  হয় তা কিন্তু নয়। নিরাপদ, নির্বিঘ্নে শেষ অবধি গন্তব্যে পৌঁছে যায় সময়ের হেরফেরে। ঐতিহ্যিক আর আপন সাংস্কৃতিক বোধে লালিত আবহমান সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ। সম্প্রীতির এক অনবচ্ছেদ বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো অস্ট্রিক এই জাতিগোষ্ঠী। স্বাধীন চেতা, স্বনির্ভর আর স্বজাত্যবোধে অনড়, অটল, থাকার সহজাত ইচ্ছেয়।

×